বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বেকারত্ব ও দারিদ্রতা নিরসনে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের ভূমিকা- সত্যের ছায়া

বিশ্বের দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলে ক্রমেই উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের গুরুত্ব অনেক।

যে সমস্ত দেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে তারা দেশের সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে মানব সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা।তা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ কাজের আসায় অলস বসে থাকে। এই অলস বসে থাকার সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশিরভাগ প্রথাগত শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী, যারা সরকারী কিংবা বেসরকারী মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি। এই প্রথাগত শিক্ষিত তরুণদের হাতে বিনিয়োগ করার মত যথেষ্ট পুঁজির অভাব রয়েছে। সুতরাং দেশের সার্বিক ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য কর্মীমুখী শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধন এবং সহজ শর্তে মূলধনের ব্যবস্থা করা জরুরী।

আমাদের দেশে প্রচুর তরুণ জনশক্তি রয়েছে; যাদেরকে উপর্যুক্ত কর্মমুখী শিক্ষা না থাকার কারণে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আবার তারা নিজেরাও উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারছেন নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতার কারণে। এই প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অন্যতম হলো প্রশিক্ষণ ও বিণিয়োগ শিক্ষার অভাব, উপযুক্ত জমির অভাব, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, প্রতিরক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থার অপ্রত্যুলতা। দিনদিন দ্রব্যমূল্য গ্যাস বিদ্যুৎের দাম বৃদ্ধি, মহামারী ও বিশ্বের বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ। দূর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এখনও ক্ষুদ্র শিল্পের নিত্য ব্যবহার্য ভাল মানের যন্ত্রপাতি— যেমন কারখানার মেশিন টুল ইত্যাদি উৎপাদিত হচ্ছেনা, যেগুলো হাতের নাগালে পাওয়া যায় সেগুলোর দাম চড়া। তাছাড়া ক্ষুদ্র শিল্পে ব্যবহৃত উৎপাদনমুখী যন্ত্রপাতি বিদেশ তথা চায়না থেকে আমদানী করে প্রয়োজন মেটাতে হয়। ফলে বহু বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হয়, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের যন্ত্রপাতির দাম প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এই সমস্ত যন্ত্রপাতি অনুকূল পরিবেশ ও সরকারের আনুকূল্য ও নীতিগত সহায়তা পেলে দেশেই তৈরী সম্ভব।

মূলধনের সমস্যার কথা কি বলব; দেশে শিক্ষিত তরুণের মাঝে মূলধনের অভাব রয়েছে। অনেক তরুণ তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশের মেধা পাচার হচ্ছে অনেকটা জেনে শুনেই। আমাদের দেশের ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত মূলধনের সমস্যায় ভোগেন। এই ব্যবসায়ীরা জীবনেও কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়নি, বা পায়নি, এবং ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার শর্তাবলী সন্তোষজনক ভাবে পূরণ করতে পারেনি। ছোট ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের আরেকটি সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় তাহলো পণ্য  উৎপাদন করার পর কি করে তা বাজারে বিপনন করতে হয় সে বিষয়েও তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই অথবা বড় বড় দেশীয় কোম্পানি বা মান্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাথে কিভাবে কৌশলী হয়ে বাজার ধরতে হবে সেটা তাদের জানা নেই।

দেশের এই সমস্যার কথা প্রথম ভেবেছিলেন শিল্পায়নের অগ্রদূত জনাব এ.কে. খান। তিনি পাকিস্তান আমলে শিল্পমন্ত্রী থাকা কালে ষাটের দশকের প্রারম্ভে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি জেলায় প্রথম স্তরে একটি করে ক্ষুদ্র শিল্প এষ্টেট স্থাপন করার পরিকল্পনা সরকারের পক্ষে গ্রহণ করেন এবং এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এই পরিকল্পনার ফলশ্রম্নতি হিসেবে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বহু বিরাটকারের ক্ষুদ্র শিল্প এষ্টেট তখন গড়ে উঠে। বাঙ্গালীর মধ্যে ব্যবসায়ী হওয়ার চিন্তা চেতনা উদিত হয়। অনেকে নাঙ্গল, জোয়াল, নৌকা ছেড়ে ব্যবসায়ী খাতায় নাম লেখান। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যের কারণে সে প্রচেষ্টা বেশি ফলপ্রস্যু হয়নি।

মূল কথা হলো জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অধিক দামে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করে তা দরিদ্র দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্যবহার করে বিশেষ কোনো উপকার পাবে না। সে জন্য অনেক উন্নয়নশীল চায়না তৈরি যন্ত্রপাতির দিকে ধুঁকছে। চায়না যন্ত্রপাতি দামে সস্তা ও সহজলভ্য। ফলে অনেক গরীব রাষ্ট্রে নিজ থেকেই উদ্যোগী হয়ে চায়নার সাথে বিজনেস ডিল সম্পাদন করছেন।

আশি দশকের পর থেকে আরব রাষ্ট্র সমূহ, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলো তেল নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। এই সমস্ত দেশ সমূহের শাসক ও এলিট সম্প্রদায় তেল থেকে আয় বাবদ টাকা দুর্ণীতির মাধ্যমে ধনী থেকে ধনী হয়েছে। অন্য দিকে অনেক রাষ্ট্র অতিরিক্ত ফুটানি দেখাতে গিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা বারোটা বাজিয়েছে; শ্রীলংকা ইতমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে, পাকিস্তান দেউলিয়া হওয়ার পথে, ভারত ও বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ অনেকাংশ হ্রাস পেয়েছে। ইয়ামেন, সিরিয়া, সোমালিয়ার মানুষদের প্রতিনিয়ত ক্ষুদা ও দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়।

এ কথা সত্য যে, দেশের কর্মশক্তি ও পেশাগত দক্ষতা ব্যবহার করে প্রযুক্তির সাহায্যে অনুন্নত দেশগুলিকে উন্নতির দিকে টেনে নিতে হয়। সে জন্য সবার আগে কর্মমুখী ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে সমস্ত পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হেয় শিল্প এষ্টেট নিজেদের তৈরী করতে হবে। তবে আশার কথা হলো বর্তমান সরকার সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে। সে লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) গঠন করেছে; যা প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীণ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর, শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল।, নাফ ট্যুরিজম পার্ক (জালিয়ার্দ্বীপ), সাবরাং পর্যটন এসইজেড, আকিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, আব্দুল মোনেম অর্থনেতিক অঞ্চল, বে অর্থনৈতিক অঞ্চল ফাইনাল লাইসেন্স পেয়েছে এবং অনেকগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ প্রি-কোয়ালিফিকেশ লাইসেন্স নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ করছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন ও অপারেটর নিয়োগের জন্য ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন ২০১০ এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন (ডেপোলভার নিয়োগ বিধি,২০১৪)” যুগপোযুগী করে প্রণীত হয়েছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য সরকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজও ভূমি কর থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এই সমস্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে একই স্থানে ফ্যাক্টরীর চাহিদানুযায়ী জমি বিক্রি ও বরাদ্দ দেয়া হয়। অর্থনৈতিক অঞ্চল সমূহে টেক্সটাইল, ফুড প্রসেসিং, ইলেট্রিক যন্ত্রপাতি, ফার্মাসিটিক্যাল যন্ত্রপাতি, ফার্মাসিটিক্যাল, মেরিণ, ফিশারিজ, এগ্রো, ভোগ্য পণ্য, অটোবোইল, খেলনা, প্লাস্টিক, রি-রোলিং মেইল, টেলিকমোনিকেশন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি স্থাপিত হবে। এতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে। আশা করা যায় অর্থনেতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পর দেশের বেকারত্ব ঘুচবে। জাতি বেকারত্বের অভিশাপ থেকে অনেকাংশ মুক্তি পাবে। দেশের   

শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে আমাদের দেশে বেকারত্ব দারিদ্র ঘুচবেনা। তবে কৃষির মাধ্যমে আমাদের দেশে শিল্পাঞ্চলে ব্যবহৃত অনেক কাচামাল উৎপাদন করা যাবে। সেজন্য কৃষিতে বৈচিত্র ও বিপ্লব আনতে হবে। এখন দেশে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈচিত্র এসেছে। মৌসুম ভিত্তিক ফলমূল চাষ হচ্ছে। মাছ, মুরগির খামার গড়ে উঠেছে।সবজি চাষ এখন লাভজনক পেশা।

তবে দেশের প্রতিটি এলাকায় স্তরে ছোট ছোট বা মাঝারি আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে না পারলে আমাদের আর্থিক অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হওয়া সম্ভবপর নয়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় পণ্য ও ভোগ্য পণ্যের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে আমাদের দেশটি আমদানি নির্ভর থেকে যাবে। বর্তমানে অনেক মূলধনী কোম্পানী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে উৎপাদিত পণ্য নিজেরাই উৎপাদন করছে। এতে করে ক্ষুদ্র মূলধনী কোম্পানিগুলো বৃহৎ কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। সরকারের এদিকটায় নজর দেয়া বাংলাদেশের জন্য কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Recent Post

Sample Notice of Share Transfer

Intimation of Intended Share Gift by Mr. DK Khan, Managing Director,  ST Securities Limited