এ. কে. খানের জীবনপঞ্জী
চিত্র: এ কে খান |
জন্মঃ ০৫ই এপ্রিল, ১৯০৫।
জন্মস্থানঃ গ্রাম-মোহরা, থানা (উপজেলা)- পাঁচলাইশ (বর্তমান চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম।
পিতা- মরহুম আলহাজ আব্দুল লতিফ খান
মাতা-মরহুমা ওয়াহাবুন্নিশা চৌধুরাণী
দাদা- মরহুম জান আলী খান চৌধুরী
পরিবারঃ একটি প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড়ের মন্ত্রী শমশের খানের পুত্র বিরাট প্রতিপত্তিশালী হামজা খানের ভাই শেরবাজ খানের যোগ্য উত্তরপুরুষ হলেন জনাব এ.কে.খান। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের সাবরেজিস্টার শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন ও পরহেজগার।
স্থায়ী ঠিকানাঃ ‘শামা’, বাটালী হিল, চট্টগ্রাম।
শিক্ষাঃ ফতেয়াবাদ হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাটিকুলেশন পাশ। চট্টগ্রাম কলে থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ.পাশ, চট্টগ্রাম ভিাগের প্রথম স্থান অধিকার এবং মহসিন বৃত্তি লাভ। ১৯২৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. (অনার্স) ডিগ্রী লাভ। ১৯৩১ সালে কলকাতা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাঙ্গালী মুসলমান পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হন এবং প্রথম পঞ্চাশ জনের মধ্যে স্থান লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে এম.এ. পাশ ও প্রথম শ্রেণী লাভ।
পেশা ও চাকুরীঃ শিক্ষাজীবন সমাপন শেষে প্রথমে কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি এবং শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের জুনিয়র হিসেবে শিক্ষানবিশী। সিভিল সার্ভিস (বিচার বিভাগীয়) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৩৫ সালে মুন্সেফ হিসেবে চাকুরী গ্রহণ। ১৯৪৪ সালে এ চাকুরীতে ইস্তফা দান। বরিশাল মুন্সেফ থাকাকালে এক মকদ্দমায় জনৈক উচ্চপদস্থ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তকর্তাকে শাস্তিদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন।
বিবাহঃ ১৯৩৫ সালে বার্মায় অবস্থানকারী প্রতিপত্তিশালী বাঙ্গালী ব্যবসায়ী ও তৎকালীন বিখ্যাত বেঙ্গল বার্মা স্টীম নেভিগেশন কোম্পানীর মালিক জনাব আব্দুল বারী চৌধুরীর কন্যা শামসুন্নাহার বেগমের সাথে রাজকীয় জাঁকজমকের সাথে বিবাহ। পাঁচ পুত্র, চার কন্যা। শ্বশুরবাড়ী ফটিকছড়ি থানার দৌলতপুর গ্রাম। স্ত্রীর মৃত্যুঃ ২৮ শে জানুয়ারী ১৯৯১।
রাজনীতিঃ মুসলমানদের জন্য আলাদা স্বাধীন আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি, এজন্য বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ এবং ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগদান। তৎকালে চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনসের (পি.আই.এ) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে ভারতীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত, তবে কায়েদে আজমের নির্দেশে তাতে যোগদান থেকে বিরত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আইন সভার সদস্য হন। ১৯৫৮ সালে পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের মন্ত্রী সভায় যোগদান এবং শিল্প, পূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ বিভাগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং ১৯৬২ সালে পদত্যাগ। ১৯৬২ সালের সংবিধান রচনা ও মূল্যায়নে অবদান রয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় দস্য। বিদ্যুৎ মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সময়ে পাক-ভারতের মধ্যে সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদন। শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বস্ত্র ও পাট শিল্পের দ্রুত প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ এবং দেশের দু’অংশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের প্রয়াস। এখানে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানা, কর্ণফুলী রেয়নমিল স্থাপন। পশ্চিম পাকিস্তানেও অনুরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠা। দেশের প্রতি জেলায় শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠা করে স্থানীয় পুঁজি ও শ্রমিক আকর্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ছোট ও মাঝারি শিল্প স্থাপণে গুরুত্বারোপ। তৎকালীন সরকারের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার।
ঢাকায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের প্রস্তাব প্রদান যাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এখানে বসতে পারে এবং অধিবেশনকালে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ এখানে চলতে পারে। এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ঢাকায় শেরে বাংলা নগর স্থাপন। মন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, বনশিল্প কর্পোরেশন ও পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক স্থাপিত।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের আশায় এয়ার মার্শাল আসগর খানের তেহরিকে ইশতেকলাল পার্টিতে যোগদান। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর অত্যাচারের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বহির্বিশ্বের উদ্দেশ্যে পাঠের জন্য ইংরেজীতে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রণয়ন করেন। যা মেজর জিয়ার (শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া) কন্ঠে ঘোষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশত্যাগ এবং মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদান।
শিল্প-বাণিজ্যঃ এদেশের শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ। প্রথম ব্যবসার ক্ষেত্রে শ্বশুরের সহযোগিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বার্মাগামী আরকান রোডের অংশবিশেষ নির্মাণই তাঁর প্রথম ব্যবসাগত উদ্যোগ।
বৃটিশ আমলে পূর্ববঙ্গ শিল্প-বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত এবং কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে অবাঙ্গালীদের হাতে শিল্প কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। এ অবস্থায় এ. কে. খান এদেশের শিল্পায়নে প্রথম বাঙ্গালী মুসলমান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে তাঁর প্রথম কারখানা এ.কে খান ফ্যাক্টরী’ স্থাপন। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শিল্প স্থাপন। ষাট দশকের দিকে তাঁর অন্যতম বড় শিল্প ‘চট্টগ্রাম টেক্সটাইল মিলস’ প্রতিষ্ঠা তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ হলো নি¤œরুপঃ
১. এ.কে. খান ম্যাচ কোঃ লিঃ
২. এ.কে. খান প্লাইউড কোঃ লিঃ
৩. এ.কে. লেদার এ্যান্ড সিনথেটিক্স লিঃ
৪. চট্টগ্রাম টেক্সটাইল মিলস লিঃ
৫. এ.কে. খান জুট মিলস লিঃ
৬. এ.কে ডকিং এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিঃ
৭. খান-এলিন কর্পোরেশন লিঃ
৮. বেঙ্গল ফিশারিজ লিঃ
৯. এস.টি.এম. লিঃ (স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলসঃ লিঃ)
১০. টোটাল থ্রেড (বিডি) লিঃ
১১. পাকিস্তান-স্টীম নেভিগেশন কোম্পানী
তাঁর শিল্প-কারখানায় শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক আদর্শ স্থানীয়। শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণের জন্য শিল্পে শ্রমিকদের শেয়ার প্রদানের পক্ষপাতী। বিশেষতঃ তিনি শিল্পোদ্যোক্তা, শ্রমিক ও অর্থযোগানদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ত্রিমুখী অংশীদারীত্বের কথা বিবেচনা করতেন। বাঙ্গালী মালিকানাধীন প্রথম ব্যাঙ্ক ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) প্রতিষ্ঠা।
সমাজসেবাঃ বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। রোটারী ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি। এ প্রতিষ্ঠানই পাহাড়তলীতে চট্টগ্রাম চক্ষু চিকিৎসা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করে। তিনি সমাজসেবা, বিশেষতঃ স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে সেবার জন্য এ.কে. খান ফাউন্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রথম সাইন্টিফিক কমিশনের সভাপতি। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর শিল্প প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ ধর্ম, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য ওয়াকফ করে গেছেন। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ, চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন সহযোগিতা। চট্টগ্রামে আর্ট গ্যালারী স্থাপনে সহযোগিতা দান।
চরিত্রঃ এ.কে খান ছিলেন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, ধার্মিক, রুচিবোধসম্পন্ন, পরিশ্রমী ও মৃদুভাষী। খুব মাতৃ-পিতৃভক্ত। আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল ছিল গভীর। এজন্য হতাশা তাঁকে স্পর্শ করেনি, ভালো কাজে উদ্যোগী ছিলেন। অবসর সময় কাটতো জ্ঞানচর্চা ও বাগান পরিচর্যায়। নিজস্ব এক পারিবারিক লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলেন। আর একটি সখের বাগান ছিল। শিল্প ও অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ রয়েছে। শিল্পকলা ও স্থাপত্যে আগ্রহী।
ইন্তেকালঃ ৩১ শে মার্চ, ১৯৯১
সূত্রঃ মেমরি ইন এ কে খান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন