রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০২৩

বাংলাদেশের সবচেয়ে রহস্যময়, ভুতুড়ে এবং বিপদসংকুল স্থান- সত্যের ছায়া

বাংলাদেশের সবচেয়ে রহস্যময়, ভুতুড়ে এবং বিপদসংকুল স্থান হলো চাঁদপুর তিন নদীর মোহনা, যার আধুনিক নাম মোলহেড।

 চাঁদপুর তিন নদীর মোহনা (মোলহেড) স্থানটি পদ্মা, ডাকাতিয়া এবং মেঘনা নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত, স্থানীয়রা যাকে কোরাইল্লার মুখ নামে ডাকে। এই কোরাইল্লার মুখ চাঁদপুরের বড় স্টেশনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। 

সন্ধ্যায় কোরাইল্লার মুখে পশ্চিমের সূর্য যখন নিভু নিভু করে ডুবে যায় তখন বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ রাশিকে গলিত স্বর্ণের মতো দেখায়। আবার কখনো কখনো সাঁঝের বেলা সূর্যের ম্রিয়মান আলোকছটা নদীর পানিতে পড়ে রক্তিম রুপ ধারণ করে। বর্ষাকালে নদীতে যখন প্রচুর স্রোত ও ঢেউ থাকে তখন তরঙ্গ রাশি মোলহেডে উপচিয়ে পড়ে। আর সেই সময় মোলহেড একটি রহস্যময় মৃত্যুকূপ হয়ে যায়। এই মৃত্যুকূপে পতিত হয়ে নিঁখোজ হয়েছে যাত্রীবাহী অনেক লঞ্চ, মালবাহী কার্গো, ট্রলার সহ অসংখ্য জেলে নৌকা। নদীতে চলাচলরত যাত্রী, জেলে এবং জাহাজ ও স্টিমারের চালকরা এখানে এক সাধু-সন্ন্যাসীকে পানির উপর ধ্যানের আসনেম দেখতে পান। এই সাধু ব্যক্তি আবার কখনো কখনো পানির উপর অনায়সে হেঁটে বেড়ান। স্থানীয়রা তার নাম দিয়েছেন গাজী-কালু। স্থানীয়দের বিশ্বাস নদীতে ঝড় উঠলে কিংবা অধিক ঢেউ থাকলে তার নাম নিয়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলে নদীর ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তার নামের ফজিলতে নদীতে উঠা বড় বড় ঢেউ ক্ষণিক পরে দুর্বল হয়ে যায়। এই মিথোলজি এখনো জেলে, নৌ-পথের চালক ও যাত্রীদের  মধ্যে  বিদ্যমান।


অনেকে আবার নদীর জলরাশিতে একজন সন্ন্যাসীকে দেখেন। তাকে লোকমুখে গঙ্গীমা বলা হয়। এই গঙ্গীমা একটি রাগী ও বদ মেজাজী চরিত্র। গঙ্গীমাকে যারা ভক্তি- শ্রদ্ধা করবে তারা নদীতে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবে। তার নামের সাথে কিংবা তার নাম নিয়ে কেউ বেয়াদবি করলে সে নদীতে ডুবে অকালে মারা যাবে। সে যে নৌ-যানে উঠবে সে নৌযান দুর্ঘটনার শিকার হতে বাধ্য। তাই নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষ সন্তান জন্ম হওয়ার পরপরই সন্তানের হাত দিয়ে নদীতে পঁয়সা ফেলে গঙ্গীমাকে নেক নজরানা দেয়। অনেক বৃদ্ধ লোক এখনো গঙ্গীমার নাম ভক্তি সহকারে স্মরণ করে।

চাঁদপুর তিন নদীর মোহনা নিয়ে অসংখ্য কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। কাহিনীর বেশিরভাগ অংশ প্রাচীনকাল থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বিদ্যামান ছিলো। এখনো প্রবীন লোকেরা এই কাহিনী বলার সময় গাজী-কালু, গঙ্গীমা কিংবা কল্পিত এক বালককে স্মরণ করে ডান হাতে চুমু খায়।

কল্পিত বালকের চরিত্রটি মোটামুটি এ রকম- প্রায় দেড়শ বছর আগে চাঁদপুর নদী বন্দর এতো বিখ্যাত ছিলোনা। নদী বন্দরের বেশ দূরে ছিলো একটি ছোটখাটো বাজার। একদিন এই বাজারে একটি অপরিচিত ঝীর্ণশীর্ণ দরিদ্র ছেলে এসে হোটেলে খাবার চায়। হোটেলের মালিক খাবার না দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়। ছেলেটি পুনরায় ফিরে এসে খাবার চাইলে হোটেল মালিক রাগে কড়াই থেকে গরম তেল  ছুঁড়ে মারে। এতে ছেলেটির শরীল গরম তেলে পুড়ে যায়। অতঃপর সে পোড়া শরীলে নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে নদীর তীরে যায়। সে পোড়া শরীল নিয়ে সারা বিকাল নদীর পাড়ে বসে থাকে। সন্ধ্যা হলে কোথায় জানি উধাও হয়ে যায়। মাঝরাতে হোটেলসহ কয়েক কিলোমিটার নদীর পাড় ধ্বসে পড়ে। সকাল বেলা হোটেলের লোকজন সে ছেলেটিকে অনেক খোঁজাখুজি করে। কিন্তু তাকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। সেই ধ্বসে যাওয়া অঞ্চলটি হলো বর্তমানে চাঁদপুরের মোলহেড। অনেকের ধারণা ঐ ছেলের অভিশাপে নাকি তিন নদীর মোহনা এতো ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে।

উক্ত এলাকায় এই ঘটনার আগে পড়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে । ইতোমধ্যে অনেকের সলিল সমাধি হয়েছে। তারপর হঠাৎ করে একটি ঘটনা বিখ্যাত হয়ে যায়, তাহলো নব্বই দশকের শেষের দিকে ঘূর্ণিপাকে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। লঞ্চটির সন্ধানে ডুবুরিরা নদীর তলদেশে গিয়ে দেখতে পান একটি বালক ছেলে নদীর তলদেশে চেয়ার পেতে বসে আছে। অতপর ডুবুরিরা ভয় পেয়ে সেখান থেকে ফিরে আসে। ডুবুরিরা ডাঙ্গায় অপেক্ষারত আত্মীয় স্বজনদের নিকট বালকের কাহিনীটি অবতারণা করে। দূর্ঘটনাকে ধাপাচাপা দিতে কিংবা  ডুবুরিদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এই গল্পের অবতারণা হয়ত। তবে বালকের যে মিথোলজি তা বেঁচে থাকুক হাজার বছর। মানুষ শিহরিত হউক অভুক্তকে খাবার না দেয়ার পরিনতি শুনে।

চাঁদপুর তিন নদীর মোহনার আশেপাশে পদ্মা ও মেঘনার জলরাশিতে আমাবস্যায় সাদা কাপড় মোড়ানো লাশের নৌকা চলাচল করতে দেখা যায়, এমনটা দাবি করেন অনেক জেলে। নদীর মাঝখানে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠা, মাঝি ছাড়া নৌকা চলাচল এবং সেই নৌকা থেকে কথোপকথন ভেসে আসে বলে অনেকে দাবি করে থাকেন। আবার অনেকে নদীর ভিতর থেকে বিদঘুটে চেহারার কাউকে ভেসে উঠতে দেখেন। কেউ কেউ আবার অশরীলী আত্মার সাথে মারামারি করার দাবি করে থাকেন।

পূণিমা কিংবা আমাবশ্যা রাতে চাঁতপুরের তিন নদীর মোহনায় বিশাল জলরাশিতে নৌকা নিয়ে ভ্রমণ করলে পানির সলাৎ সলাৎ শব্দ, বাতাসের হু..হু. আওয়াজ, মাঝে মাঝে পাখির ডাক, দূর দেশ থেকে তরঙ্গে ভেসে আসা মাঝিদের অচেনা সাংকৃতিক কথোপকথন, কিংবা আধুনিক কোন নৌজান ইঞ্জিনের একটানা শব্দ আপনাকে বিমোহিত করতে বাধ্য। রাতের আঁধারে বিশাল জলরাশির মাঝে আপনি হারিয়ে যাবেন ভৌতিক কোন স্থানে। হয়ত ভাববেন এই বুঝি গঙ্গীমা আমার উপর রুষ্ট হয়ে পা টেনে ধরে নিয়ে যাবে অতল গহব্বরে। কিংবা কল্পনায় গাজী-কালু পীরের ছবি আঁকবেন। আর ভাববেন এই বিপদের দিনে গাজী-কালুই আমার ভয়সা। হে গাজী-কালু রক্ষা করো এই মোর প্রার্থনা।

বাস্তবাতা হলো চাঁদপুর মোলহেডে তিনটি নদীর স্রেত এক সাথে মিলিত হয়ে পানির একটি ঘূর্ণি সৃষ্টি করে। এই ঘূর্নির ভিতর ছোট ছোট নৌকা, ট্রলার পড়লে আর রক্ষা নেই, পাক খেয়ে তলিয়ে যায়। কালবৈশাখী ঝড় উঠলে প্রচুর উঁচু উঁচু ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, সাথে প্রবল স্রোত থাকে। এই ঢেউ আর স্রোতের মিশেল এবং কালবৈশাখীর ঝড় যেন সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে নেমে আসে। এই যমদূতের কবলে পড়লে  মানুষ বিভিন্ন কিছু কল্পনা করবে এটাই স্বাভাবিক। আর ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে সৃষ্টিকর্তার নাম নিবে, সাথে কোন কল্পিত অবতার, সূফি, সাধক কিংবা সন্ন্যাসিনীর নেক নজর চাইবে এটা মানুষের প্রাকৃতিক এবং জন্মগত বৈশিষ্ট্য। অনেকে নদীর ঝড় থেকে রক্ষা পেয়ে নিজের বাহাদুরিও প্রচার করে থাকেন।

মোলহেড এলাকাটি মূলত বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কয়েক হাজার নিরীহ বাঙ্গালিকে ধরে এনে এখানে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। নিরাপদ মানুষের রক্তে লাল হয়ে যায় পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার পানি। আমি মোলহেডে গেলে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত সাধারণ মানুষের করুণ আর্তনাদ শুনতে চেষ্টা করি। সে সময় মানুষের বেঁচে থাকার আর্তনাদ আমার কানে মাঝে মাঝে  ভেসে উঠে।

এতো কিছু ছাপিয়ে মোলহেড এখন চাঁদপুরের আকর্ষণীয় পর্যাটন স্থান। মোলহেডে গড়া উঠা পর্যটন স্থানকে 'বঙ্গবন্ধু পার্ক' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশ বিদেশের বহু পর্যটক মোলহেডে যান তিন নদীর সঙ্গমস্থল দেখতে। আপনি যাবেন নাকি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Recent Post

Sample Notice of Share Transfer

Intimation of Intended Share Gift by Mr. DK Khan, Managing Director,  ST Securities Limited