সালদা নদীপথে অ্যামবুশ, ১০ জুলাই ১৯৭১: আমি সালদানদী রেলওয়ে স্টেশনে শত্রুর আসা-যাওয়া এবং রসদ সরবরাহের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখতাম। ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট মন্দাবাগ বাজারে ঘাটি গেড়েছিল। কোম্পানীগঞ্জ থেকে স্পিডবোটের মাধ্যমে সালদানদী হয়ে মন্দাবাগ বাজার ও সালদানদী স্টেশনে অবস্থিত শত্রুর ঘাঁটিতে রসদ ও গোলাবারুদ আসত। সেদিন ছিল ১০ জুলাই আমাদের জন্য একটা অত্যন্ত ভালো দিন ।
আমি সুবেদার ওহাবকে স্পিডবোটের কনভয়টিকে অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম । দ্রুত আলোচনা করে আমি একটা পরিকল্পনা নির্ধারণ করলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার ওহাবকে আমি একটি সেকশন (১০ জনের সংগঠন) সৈন্য সহ নদীর অপর পাশে তথা পশ্চিম পারে নির্ধারিত জায়গায় অবস্থানের জন্য আদেশ দিলাম। আমি ও সুবেদার মঙ্গল মিয়া অপর দুটি শয়ে নদীর পূর্ব পারে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অ্যামবুশ পাতি। আমাদের সৈন্যদের অনেকেই নদীর পারে ধানখেতে বুকসমান পানিতে দাঁড়িয়ে অবস্থান নিয়েছিল। আধ ঘন্টার মধ্যেই মন্দাবাগ বাজারের দিক থেকে স্পিডবোটগুলো আসার শব্দ শুনতে পেলাম । দুটো স্পিডবোট আমাদের পাতা ফাঁদের দিকে এগিয়ে আসছিল। আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দিয়েছিলাম যে আমি গুলি না ছোড়া পর্যন্ত যেন কেউ গুলি না ছোড়ে। স্পিডবোট দুটি ১৫০ গজ ব্যবধানে এগিয়ে আসছিল। এগুলো ছিল ছাদখোলা।
প্রথম স্পিডবোটে দেখা গেল দুই - তিনটি ছাতার নিচে লোক বসে আছে। পেছনের স্পিডবোটটি অস্ত্রসজ্জিত সৈন্যে বোঝাই ছিল । দেখে বোঝা যাচ্ছিল, প্রথম বোটটিতে ছাতার নিচে বসা লোকগুলো পাকিস্তানি সেনা অফিসার। নদী এ সময় ৩০-৪০ গজ প্রশস্ত ছিল। দুটি স্পিডবোটই যখন আমার ফাঁদের কিলিং জোনের ভেতরে প্রবেশ করল, তখন প্রথম স্পিডবোটের ভিআইপি আরোহীদের লক্ষ্য করে আমি আমার সাব- মেশিনগান থেকে গুলি চালালাম । সঙ্গে সঙ্গেই পুরো অ্যামবুশ পার্টির সবাই একযোগে টার্গেট লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি চালান। এই গুলিবর্ষণ চলেছিল পাঁচ মিনিট ধরে এবং শত্রুরা এর কোনো জবাব দেওয়ার সময়ই পায়নি। শত্রুরা সবাই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সাঁতার না জানা এই সৈন্যরা কেউ ডুবে আবার কেউ গুলিতে নিহত হলো। অবশ্য একজন ক্যান্টেন (সম্ভবত একজন বাঙালি ডা.) পানি থেকে আবার স্পিডবোটে উঠতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়।
গুগল ম্যাপে সালদা নদী।স্পিডবোটগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ডুবে যায়নি। আমার আদেশে সুবেদার মঙ্গল মিয়া বোটগুলো পাড়ে নিয়ে আসে এবং প্রথম বোট থেকে আমরা একজন মৃত পাকিস্তানি ক্যান্টেনের লাশ পাই। আমরা তার ব্যাজেজ অব র্যাঙ্ক প্রমাণস্বরূপ ছিঁড়ে নিই। এ ছাড়া বোটগুলোতে আমরা দুটি এমজি, একটি ৭.৬২ মিমি চায়নিজ রাইফেল, দুটি ৭.৬২ মিমি চায়নিজ সাব- মেশিনগান, সমগ্র এলাকার একটি আর্টিলারি ম্যাপ (যাতে শত্রুর যুদ্ধপরিকল্পনার নানা দিকনির্দেশনা ছিল), দুটি পিআরসি (পোর্টেবল রেডিও কমিউনিকেশন) সেট, ১০ টি ছোট আকারের ওয়্যারলেস সেট এবং কিছু গোলাবারুদ পাই।
পরে ওয়্যারলেস ইন্টারসেন্ট থেকে আমরা জানতে পারি যে এই অ্যামবুশে ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাজহারুল কাইউমসহ পাঁচজন অফিসার এবং নয়জন অন্যান্য র্যাঙ্কের সৈনিক ও বেসামরিক ব্যক্তি (সম্ভবত একজন ইঞ্জিনিয়ার) নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, একজন মেজর, একজন ডাক্তার, একজন ক্যাপ্টেন, একজন আর্টিলারির ক্যাপ্টেন এবং একজন লেফটেন্যান্ট ছিল। এ ছাড়া ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর গজনওয়াব আলী টিকে- ও নিহতদের মধ্যে ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে একটি অপারেশনে এত বেশিসংখ্যক পাকিস্তানি অফিসারের একত্রে নিহত হওয়ার আর কোনো উদাহরণ নেই। এরা সবাই কুমিল্লা টাউনে সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করেছিল, আর্টিলারির নিহত ক্যাপ্টেন বুখারি কুমিল্লা শহরে একজন নিয়মিত ধর্ষক, গণহত্যাকারী ও মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত ছিল। যা - ই হোক, যেকোনো বিচারে আমার এই অ্যামবুশটি ছিল একটি অভূতপূর্ব সফল অ্যাকশন।
সূত্রঃ স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন- এইচ এম আব্দুল গাফ্ফার, বীর উত্তম।
....................................................
ক্যাপ্টেন (অনারারি) ওহাব এর ভাষায় সেদিনকার ঘটনা
ঝিকুরা অভিযান: নদীতীরে অ্যাম্বুশ
কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষের কাছে এক ভয়ংকর কিংবদন্তি পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বুখারি। এই নৃশংস অফিসার নাকি এক হাতে জিপের স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে গুলি করে বাঙালি মারত, অবলীলায়।
‘চরিত্র খারাপ ছিল তার, মেয়েদের পেছনে লেগেছিল,’ বলেন ওহাব।
ঝিকুরা গ্রামের পাশ ঘেঁষে বইছে সালদা নদী। ওহাব বললেন, এখন নদী একটু মরা। ২৫ বছর আগে এই জায়গায় একটা বটগাছ ছিল। সেই বটগাছের নিচে এলএমজি নিয়ে পজিশন নিয়েছিলাম আমি। তখন বর্ষাকাল। এসব জায়গা ছিল বিলের মতো। পানিতে আধোডোবা ধানখেত, পাটখেত।
ক্যাপ্টেন ওহাব (অনারারি)
একাত্তরের ১০ জুন। আগের দিন ভারতের কোনাবন ক্যাম্পে কোম্পানি অধিনায়ক গাফফার সাহেবের কাছে ঝিকুরা অভিযানের জন্য অনুমতি নিয়েছেন ওহাব। বলেছেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা কসবা থানার সালদা নদী, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর এলাকায় প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছে। এসব এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী রসদ পাঠায়, আসা-যাওয়া করে নদীপথে। কুমিল্লা থেকে সিঅ্যান্ডবি
সড়ক দিয়ে আসে কালামুড়িয়া ব্রিজ পর্যন্ত। তারপর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ওঠে নৌকায়। সালদা নদী দিয়ে শত্রুর এই চলাচল বন্ধ করে দিতে চাই। চাই নদীতে অ্যাম্বুশ করতে।’ অনুমতি মিলেছে। এবার অপারেশন।
তাঁর প্লাটুন নিয়ে খুব ভোরে কোনাবন ক্যাম্প ছাড়লেন কমান্ডার ওহাব। ২২ জনের দল। সহ–অধিনায়ক নায়েক সুবেদার মঙ্গল মিয়া। ভারী অস্ত্রের মধ্যে একটি মেশিনগান ও সাত–আটটি এলএম। নৌকায় যাত্রা।
ঝিলমিল ধানখেত পেরিয়ে কলতাদিঘির পাড় ও নেপতারহাট হয়ে পৌঁছালেন মইনপুর গ্রামে। দূরে দেখা যাচ্ছে সালদা নদী। এই নদীই পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগের পথ। ওহাব দেখলেন, নদী দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সামনে স্পিডবোট, পেছনে কয়েকটা নৌকা। স্পিডবোটটা খানিকক্ষণ পরপর থামছে, যাতে পেছনের নৌবহর আবার আসে তার কাছে। নৌকায় সৈন্য, নৌকার দুই পাশে নদীতীর ঘেঁষেও সৈন্য। ওহাবের আফসোস হলো। আরেকটু আগে এসে পৌঁছালেই তো ওদের আক্রমণ করা যেত। যাক, অসুবিধা নেই।
আগে থেকেই তিনি জানেন, দিনে দিনেই একই পথে ফিরে আসে ওরা।
এ এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। সুতরাং যেকোনো অভিযান পরিচালনার আগে নিজেদের প্রতিরক্ষা ও প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা দরকার। তাই মইনপুরের উত্তরে কামালপুর গ্রামের পূর্ব দিকে বিনি নদীর পশ্চিম পাড়ে ব্রিজের কাছে রাখলেন হাবিলদার মুসলিমকে, মেশিনগানসমেত। মইনপুরের দক্ষিণ-পূর্বে কায়েমপুর গ্রামে একটি এলএমজি বসানো হলো, মন্দভাগ বাজারের দিতে তাক করে। আর মইনপুরেরই উত্তর-পশ্চিমে রইল আরেকটি এলএমজি, গোবিন্দপুরের দিকে মুখ করে।
পরের কাজ হলো অ্যাম্বুশের জন্য উপযুক্ত জায়গা বাছাই। দলকে মইনপুরে রেখে নিজে গেলেন ওহাব, নদীর ধারে, ঝিকুরা গ্রামের পাশে। বটগাছের কাছের জায়গাটা পছন্দ হলো তাঁর।
দুপুর ১২টার দিকে দল নিয়ে নদীর ২৫ গজের মধ্যে পজিশন নিলেন। এলএমজিসহ নিজে রইলেন বটগাছের পাশে। সঙ্গে রইল পাঁচ–ছয়জন। আর নায়েক সুবেদার মঙ্গল মিয়া তিন–চারটি এলএমজিসহ নদীর পশ্চিম পাড়ে পজিশন নিল কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে। বটগাছের ঠিক উত্তর দিকে ২৫–৩০ গজের মধ্যেই রইল আরও একটি সশস্ত্র দল। বটগাছের দক্ষিণে আগাম সংকেত দেওয়া ও দরকার হলে গুলি করার জন্য মোতায়েন করা হলো সিপাহি শামসু ও অন্য একজনকে।
পুরো দলটি মিলেমিশে আছে পানি, ধানখেত, শণগাছের আড়ালে। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা শত্রুর জন্য। ১২টা থেকে ২টা—পেরিয়ে গেল দুই ঘণ্টা। এর মধ্যে দেখা গেল, একটা স্পিডবোট আসছে দ্রুতগতিতে। একেকটি মুহূর্ত যাচ্ছে, আর শত্রুর স্পিডবোট নিকটতর হচ্ছে। সেটি ঢুকে পড়ল ফাঁদ-দলের আওতার মধ্যে। ওহাব তাঁর এলএমজির নল তাক করলেন স্পিডবোটের দিকে। শুরু হলো গুলি। তাঁর গুলির সঙ্গে ২০টি নিপুণ হাত একযোগে ফায়ার শুরু করল। সুবেদার ওহাব প্রথমে অনুভূমিকভাবে, পরে রিফু করার মতো খাড়া করে বুনলেন বুলেটের সেলাই।
স্পিডবোটে কতগুলো ছাতার আড়ালে ছিল পাকিস্তানি অফিসাররা। মুহূর্তের মধ্যে সব কটি ছাতা উল্টে ছিটকে পড়ল পানিতে। শতচ্ছিদ্র–অচল হয়ে গেল বোটটি। শত্রুসেনাদের দেহ লুটিয়ে পড়ে রইল বোটে। একজন শত্রু পড়ল পানিতে। হাত–পা দিয়ে পানি ঠেলে সে চেষ্টা করল নিজের দেহ খাড়া করতে। ফলে ওহাবকে খরচ করতে হলো আরও দুটো বুলেট। তারপর সব নীরব।
সবাই দৌড়ে গেল স্পিডবোটের কাছে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে এক অফিসার। শরীর উল্টিয়ে মুখ দেখে তাকে চিনলেন ওহাব। ক্যাপ্টেন বুখারি। তার দেহে বিদ্ধ হয়েছে ৭০–৭২টি বুলেট।
১২ জন পাকিস্তানি অফিসার মারা পড়ল এ অভিযানে। এদের মধ্যে ২ মেজর, ৪ ক্যাপ্টেন ও ১ সুবেদার মেজর। ছিল এক বাঙালি মেডিকেল অফিসার ও দুজন লে. কর্নেল। তাঁদের হাতের অস্ত্র হাতেই ধরা ছিল। গুলি করার সময় পাননি তাঁরা।
স্পিডবোটের পেছনে নৌকাসমেত যে শ খানেক পাকিস্তানি সৈন্য ধীরে ধীরে আসছিল, গোলাগুলির শব্দ পেয়ে তারা আর আসেনি। মইনপুরের একজন দরবেশ ফকিরের কাছে জানা গেল, ক্রলিং করে কসবা চলে গেছে ওরা।
একটা খুব দরকারি ম্যাপ পাওয়া গেল। এতে এই এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর গোলন্দাজ অবস্থান চিহ্নিত ছিল। পাওয়া গেল অস্ত্রশস্ত্র, ওয়্যারলেস। ডুবন্ত স্পিডবোটের ইঞ্জিন খুলে এনে রাখা হলো পাটখেতে।
সফল অভিযান শেষে ফিরছে ওহাবের দল। এমন সময় ৯ প্লাটুনের কমান্ডার নায়েব সুবেদার শহীদ ছুটে এলেন। ক্যাপ্টেন বুখারি মারা গেছে শুনে তিনি খুব খুশি। পাকিস্তানিদের হাত থেকে পাওয়া মেশিনগানটি তুলে নিলেন। ২৫০টি গুলির শিকল গলায় জড়ালেন সাপের মতো। ছুটে গেলেন আগে আগে, কোম্পানি কমান্ডার গাফফার সাহেবের কাছে। তাঁর কাছে খবর পেল গ্রামবাসী আর ক্যাম্পের লোকজন। ওই আসছে ওহাব, স্পিডবোট আর অনেক অফিসার আর ক্যাপ্টেন বুখারিকে মেরে।
চারদিকে তখন হর্ষধ্বনি। জয় বাংলা ধ্বনির ভেতর দিয়ে সারা দিন পানি ডিঙানো উপোস কাটানো রণক্লান্ত ওহাবের দল ক্যাম্পে ফিরে এল।
ঝিকুরার পাশ ঘেঁষে সেই নদী এখনো বয়ে চলেছে। ছোট খাড়া খরস্রোতা নদীর ওপরে এখন বাঁশের সাঁকো। কালের সাক্ষী বটগাছটা নেই। নদীটাও খানিক সরে এসেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন