বাংলাদেশে গ্রামীণ অবকাঠামোতে
ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে; সাথে মানুষের জীবন যাত্রার ধরণ পাল্টিয়েছে। গ্রামীণ জনগণ এখন
শহরের সাথে তাল মিলানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই তাল মিলানোটা অর্থনৈতিক রেখার সাথে
সমানুপাতিক হারে না হওয়ার কারণে নানা রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। শহুরে জীবন ধারণের
অনুসঙ্গ এখন গ্রামের নাগলের চলে এসেছে। গ্রামের মানুষ এখন আর কেউ ছাই, কয়লা বা
গাছের বাঁকল-পাতা দিয়ে দাঁত মাজে না। প্রতিটি অবস্থাপন্ন পরিবারে ফ্রিজ, এলইডি
টিভি, সিল্ডিন্ডার গ্যাসের চুলা এবং উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তি হাতের নাগালে রয়েছে।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোর
মার্কেটিং টার্গেট গ্রামীন জনগণ। আগেরকার দিনে গ্রামের মেয়েদের নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে
জীবন কাটাতে হত এবং লেখা পড়া জানা মেয়েদের সংখ্যা ছিল নগন্য। সেখানে এখন প্রতিটি ঘরে
ঘরে মেয়েদের লেখা পড়া চলে।
লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান
তালে লড়েছে। সরকার মেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বড় ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে
বাধ্যতামূলক করেছেন। স্কুলে প্রতিটি মেয়ে উপবৃত্তি পাচ্ছে। স্মাতক পর্যন্ত অবেতনিক লেখাপড়া
চলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের জন্য আলাদা কোটা রয়েছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা,
কুসংস্কার, অজ্ঞতা কিংবা মূর্খতা এখন একেবারে বিদায়ের পথে।
ছনের ঘর এখন জাদুঘরে কিংবা
শহরের জনগণের বিলসিতার অনুসঙ্গ। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বুঝতে শিখেছে, পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত
করে তুলতে না পারলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। গ্রামের মধ্যবিত্ত
পরিবারের ছেলেরা ঢাকাতে এসে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন
করার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের বড় একটি অংশ তৃণমূল থেকে উঠে
এসেছে। দেশের প্রধান বড় দলগুলো তৃণমূল রাজনৈতিক সংগঠন মজবুত করার জন্য প্রতিনিয়ত নানা
পদক্ষে নিচ্ছে।
গ্রামীণ কৃষক এখন মৌসুমী
ফসলের উপর নির্ভরশীল না থেকে নানা ধরণের ফসল ফলিয়ে অর্থনীতীতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
উন্নত কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের হাতে হাতে পৌছে গেছে। গরু ও নাঙ্গল পদ্ধতিতে হাল চাষ বিলুপ্তির
পথে। কৃষক ও কৃষি এখন উন্নত প্রযক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। সময়মত সার, কিটনাশক, আগাছা দমন
সম্পর্কে কৃষকদের পরিস্কার ধারণা আছে। অনেক সরকারী-বেসরকারী এনজিও প্রতিষ্ঠান কৃষকদের
দক্ষতা বিষয়ক নানা কর্মকৌশল শিক্ষাচ্ছেন। টিস্যুকালচার, হাউব্রিড, অর্গানিজ পদ্ধতিতে
শাক সিজন্যাল সবজি ও ফসল চাষ কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ ও বেকার ছেলেরা
কৃষি কাজ করে আত্ম নির্ভরশীল হচ্ছে। সেচ ভিত্তিক চাষ এখন সবার উপরে। কৃষি সেবা দিতে
তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন অ্যাপস ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। গ্রামের শিক্ষিত তরুণরা
উদ্যোক্তা হিসেবে ভালো সফলতা দেখাচ্ছে।
দেশের বেসরকারী ব্যাংকগুলো
এখন গ্রামে শাখার বিস্তার ঘটাচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকের বড় গ্রাহক এখন গ্রামীণ জনগণ। মোবাইল
ব্যাকিং সেবা, যেমন বিকাশ, রকেট, এম ক্যাশ, মাইক্যাশ, শিউর ক্যাশ এখন প্রতিটি পরিবারের
দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ ব্যাংকে একাউন্ট খুলছেন। স্বাস্থ্য
বীমা, জীবন বীমা, পেনশন বীমার নাম শুনলে মানুষ এখন আর হ্যা করে তাকিয়ে থাকেনা। বিভিন্ন এনজিওগুলো
গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের বিনা জামানতে ঋণ
কর্মসূচি ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন এনজিও সংগঠন, সমিতি গড়ে
উঠেছে। হাট বাজারের ব্যবসায়ীরা এখন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের মুলধনের
পরিমাণ বৃদ্ধি করছেন।
সোশ্যাল মিডিয়া এখন গ্রামীণ
জনজীবণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সোলোনার খেলে দেখে গ্রামীণ
দর্শকরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেকে তাদের নানা সমস্যার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায়
তুলে ধরেছেন। প্রতিটি ঘরের এনড্রয়েড মোবাইলের জয়জয়কার। সরকার মেয়েদের অপরাজিতা সিম কার্ড
বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। প্রবাসীরা মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে বিশেষ করে ফেসবুক,
ইমো, টুইটার, হোয়ার্টআপ, ভাইভার, ট্যাংগো ইত্যাদি
অ্যাপসের মাধ্যমে ছবি দেখে ও ভিটিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। প্রতিটি
ইউনিয়নে সরকার তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু করেছেন। গ্রামীণ তরুণরা যাতে বিভিন্ন কর্মদক্ষতামূলক
কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে সেজন্য সরকার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ,
হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, সাঁটালিপি প্রশিক্ষণ, রেফ্রিজারেটর মেরামত প্রশিক্ষণ, মোবাইল
সার্ভিসিং প্রশিক্ষণ, হাঁস-মুরগী, গবাদী পশুপাখি চিৎিসা প্রশিক্ষণ দিচ্ছন।
গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাগুলো
এখন পিছঢালা পথে পরিণত হচ্ছে। যেগুলো এখন বিলের মাঝে চলার পথ ছিল সেখানে এখন মহাসড়ক
নির্মাণ হচ্ছে। নদীতে বড় বড় সেতু নির্মাণ হচ্ছে, খালের মাঝে সাঁকোর পরিবর্তে কালভার্ট
কিংবা ব্রিজ নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
কৃষকরা পচনশীল কৃষি দ্রব্য এখন অতি দ্রুত মার্কেটে বিপণন করতে পারে, ফলে কৃষকের আর্থিক
ক্ষতি এবং সময় লাঘব হয়েছে।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও গ্রামের
ছেলের অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে। দেশের জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসে ভালো প্রতিভার স্বাক্ষর
রাখছেন। ক্রিকেট, ফুটবল, হাডুডু, হকি ইত্যাদি জাতীয় দলে খেলা খেলোয়ারদের অধিকাংশ গ্রামীণ
পরিবার থেকে উঠে এসেছে। কলসিঁদুরের মেয়েরা বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে আলাদা স্থান দখল করে থাকবে।
চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল
পরিবর্তণ ঘটেছে। মা ও শিশুর মৃত্যুর হার অনেকাংশ কমে গেছে। প্রসবকালীন মায়েরা এখন হাসপাতাল
সেবা নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। গ্রামে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল এজেন্সি গড়ে উঠেছে।
সরকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য হাসপাতাল গড়ে তোলে সেখানে বিনামূল্যে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে,
যেখানে বিদ্যুৎ যাওয়া কষ্ট সাধ্য সেখানে সৌর বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। উৎসব
পার্বণেও এসেছে পরির্তন।
সবকিছুর পরিবর্তন ঘটেছে
অতিদ্রুত। কিন্তু তার সাথে তাল মিলাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নানা রকম চড়াই উৎরাই পোহাতে
হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা বাণিজ্যকরণের ফলে তুলণামূলক দরিদ্ররা উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করতে
পারছেন না। ফলে অনেক সম্ভাবনাময়ী তরুণের স্বপ্ন অকালে ঝড়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ও ডিস ভিত্তিক
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে বিদেশী অপসাংস্কৃতি দেশের তরুণদের বিভ্রান্তি করেছে।
অনেকে অপকালচারে জড়িত হয়ে নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন। কিশোরদের মাঝে গ্যাংস্টার গ্রুপ গড়ে
উঠেছে। কেউ কেউ সাইবার ক্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিদেশী সিরিয়ালের প্রভাবে পরকীয়ার মত অপসাংস্কৃতি
দ্রুত বিস্তার ঘটেছে, ফলে পরিবারে অশান্তি ও শান্তি সৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। অনেকে গরীব
ঘরের মেয়ে পিতার অক্ষমতার ধরুন বিদেশী ড্রেস পরিধান করতে না পেরে আত্মা হত্যা করেছে।
পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে ইউরোপীয়
স্টাইলে একক পরিবার ঘড়ে উঠেছে। সবচেয়ে মারাত্মক অবনতি ঘটেছে বৃদ্ধ বাবা-মা প্রতিপালনে।
অনেক দরিদ্র বাবা-মা পৌঢ় বয়সে ছেলে/বউদের অবহেলার অযন্তের শিকার হচ্ছেন। আগে যেখানে থানায় মামলা বলতে
ছিল গরু চুরি কিংবা জায়গা জমিন সংক্রান্ত, সেখানে এখন গ্রামীন জনগোষ্ঠী মারাত্মক ও
নিত্য নতুন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। গ্রামে এখন দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রতিহিংসা,
মিথ্যা ও হয়রাণীমূলক মামলার জয়জয়কার। প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক দলাদলীতে জড়িয়ে অনেকে
খুন খারাপিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলে মেয়েরা অবাধ যৌনচারে জড়িয়ে প্রত্যারণা শিকার হয়ে আত্মার
হত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। অনেক লম্পট ধর্ষণের ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে স্যোশাল মিডিয়াতে
ছড়িয়ে দিচ্ছে, ফলে মেয়েদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। মাদ্রকদ্রব্য এখন গ্রামে সহজলভ্য
হয়েছে। ইয়াবার বড় বড় চালান গ্রামে যাচ্ছে। কিছু বিপদগামী ছেলে ইয়াবার ডিলারশিপ নিয়ে
তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাজণেতিক প্রভাব খাটিয়ে অনেকে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
এর থেকে আমাদের বের হয়ে
আসতে হবে। এজন্য সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা এনজিওদের ভূমিকা রাখতে হবে। স্বল্প,
মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পণা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ণ করতে হবে। অপসাংস্কৃতি রোধে
সরকারের যথাযথ ভূমিকা নিতে হবে। দেশের প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও দায়িত্বশীল অনলাইন মাধ্যমে
প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। মাদ্রক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হতে হবে। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রসার ঘটাতে হবে। শরীরচর্চা ও খেলাধূলার ব্যাপারের তরুণ-তরুণীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রম কে বাণিজ্যকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাহলে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের পথ পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন