বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

কোদালপুর ইউনিয়ন পরিচিতি

নামকরণঃ কোদালপুর ইউনিয়নের নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নদীর বুকের চর জাগার কারণে এক শ্রেণির মানুষজন মাটিকাটা ও বালুকাটার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া অত্র এলাকার একটি সম্প্রদায় আদি কালে খাল কাটা ও রাস্তা নির্মাণ কাজে শ্রমিক হিসেবে জড়িয়ে পড়েন। এই সম্প্রদায়ের লোকজন যখন কাজ শেষে ঘরে ফিরত তখন তাদের হাতে ও কাঁধে কোদাল থাকত। এই কোদাল মেরামত ও বিপণী করার জন্য একটি বাজার ভিত্তিক ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সেই থেকে অত্র এলাকার নাম হয় কোদালপুর। পরবর্তীতে নদী ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত এই সম্প্রদায় এখানে টিকে ছিল। কিন্তু নদী ভাঙ্গা শুরু হলে তারা অন্যত্র বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী চাঁদপুর, হাইমচর, মুলাদী ও বরিশালে চলে যায়। নদী ভাঙ্গার কয়েক যুগ পর পুনরায় চর জাগলে আগের নাম (কোদালপুর) বহাল থাকে।


পরিচিতিঃ কোদালপুর ইউনিয়ন ঢাকা বিভাগের আওতাধীন শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন।

অবস্থানঃ এ ইউনিয়নের পূর্বে দিকে মেঘনা নদী। দক্ষিণে চর মাইজারা ইউনিয়ন। পশ্চিমে পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়ন এবং উত্তরে আলাওলপুর (সাবেক গরীবেরচর) ইউনিয়ন অবস্থিত।

ভূপ্রকৃতিঃ কোদালপুর ইউনিয়নটি মূলত নদী ও খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই প্রতি বর্ষা মৌসুমে এখানে প্রচুর পরিমান পলিমাটি জমা হয়।তাই এখানকার ভূপ্রকৃতি বা মাটি প্রধানত দোঁশ মাটি। মাটির আকার সমতল। বর্ষাকালে সমস্ত ইউনিয়ন প্লাবিত হয়।

আয়তনঃ কোদালপুর একটি বৃহৎ ইউনিয়ন। আয়তন হিসেবে 9,620 একর।

যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ
(ক) সড়কঃ কোদালপুর ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে আধুনিক হয়ে উঠেছে। নব্বই দশকে প্রচুর কাঁচা রাস্তা (সড়ক) থাকলেও এখন আস্তে আস্তে তা পাকা করণ ও কার্পেটিং করা হচ্ছে। গোসাইরহাট বাজারের বাস স্টান্ড (পট্টি বাস স্টান্ড) থেকে একটি মহা সড়ক কোদালপুর হয়ে, আলাওলপুর, মোল্লাবাজার, (চরকুমারিয়ার) এব ডিএমখালীর ভিতর দিয়ে সখিপুর পর্যন্ত চলে গেছে। সখিপুর থেকে কার্তিকপুর ও মাওয়া ঘাটে যাওয়া যায়। মাওয়া পার হয়ে ঢাকা আসা যাবে। অপর দিকে গোসাইরহাট হয়ে জেলা সদরে যাতায়াত করা যায়। জেলা সদর থেকে মাওয়া ঘাটে আসা যায় এবং মাওয়া ঘাট থেকে সরাসরি ঢাকা যাতায়াত করা যাবে।

(খ) নদীপথঃ
লঞ্চ ঘাটঃ 1টি
নদীঘাটঃ 2টি (কোদালপুর এবং বালুচর বাজার)
কোদালপুর ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বাংলাদেশের একটি বড় নদী তথা মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। এই মেঘনা নদী দিয়ে ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রামের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে। মেঘনা নদী থেকে দুটি শাখা নদী উৎপন্ন হয়ে কোদালপুরের দুই পাশ দিয়ে চলে গেছে।
তার মধ্যে একটি ঠান্ড বাজার থেকে শুরু হয়ে বালুচর বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোদালপুর নদীঘাটে (উকিল পাড়া বা উকিল নগরের কাছে) এসে অপর দুইটি শাখা নদীর সাথে মিলে ত্রিমোনা সৃষ্টি করেছে, এই শাখা নদীর একটি দিয়ে ডামুড্যা উপজেলায় এবং অপর একটি দিয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলায় যাতায়াত করা যায়।

অপর দিকে আরেকটি নদী কোদালপুর লঞ্চঘাটের কাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে গোসাইরহাটের জয়ন্তী নদীর সাথে মিসে গেছে। এই নদীর সাথে সম্পৃক্ত করে কয়েকটি খাল কাটা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় অনেকগুলো খাল হারিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় যে খাল কাটা হয়েছিল সেটি খালাসি কান্দির কাছ থেকে শুরু হয়ে আব্দুর রাজ্জাক বালিকা বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে কোদালপুর বাজার পর্যন্ত চলে গিয়েছে।কিছু অসাধু ব্যক্তি সেই গালটির বুকে রাস্তা নির্মাণ করে এবং  অবৈধ স্থাপনা তৈরী করে খালটি দখল করে রেখেছে।

নদীপথে চলাচল ও মালমাল পরিবাহনের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে, মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো কোষা নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চ।কোদালপুর থেকে নদী পথে ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগের জন্য লঞ্চ একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সকাল 8:00 টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে একটি এবং রাত্রে 8:00 টায় ও 10:00 টায় অপর দুটি লঞ্চ (কাজল ও স্বর্ণদ্বীপ অথবা আওলাদ) ছেড়ে যায়। অপরদিকে ঢাকা থেকে প্রতিদিন সকাল 8:00টায় এবং রাত্রে 9:00 টায় ও 10.30 এ দুটি লঞ্চ কোদালপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, কোদালপুরের কোন রেল ও বিমান যোগাযোগ নেই।

জীবনযাত্রাঃ এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। অতীতে অনেক জেলে পরিবার থাকলেও আস্তে আস্তে তার সংখ্যা কমে আসতেছে। এর অন্যতম কারণহলো নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদীতে পর্যান্ত মাছ না পাওয়া এবং মহাজনী সুধ ঔ ঋণের আকার ইত্যাদি। এছাড়াও স্বল্প পরিমাণে সরকারী-বেসরকারী চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী ও প্রবাসী রয়েছে। এখানকার মানুষ সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করে। তারা অনেক অথিথেয়তাপ্রবন।বর্তমানে অনেকে রাজধানীমুখী হচ্ছে। কোদালপুরের বিয়ের অনুষ্ঠান আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। 2000ইং সালের আগ পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠান বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে অনুষ্ঠিত হত। এর অন্যতম কারণ হলো কোদালপুরে প্রচুর পরিমাণে মরিচ ফলত। এই মরিচের ভাল দাম পাওয়া যেত এবং মানুষ মরিচ বিক্রি টাকা দিয়ে অনায়সে ও স্বাচ্ছন্দে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পারত। বৈশাখের পরে শীতকালে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হত। বর্ষাতে সামান্য পরিমান বিয়ের আয়োজন চলত। পরবর্তীতে কৃষি নির্ভরতা কমে আসলে এ রেওয়াজ কমতে থাকে। 2005 সালের পর থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণত ঈদের পর থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে থাকে। কোদালপুরে মূলত বিয়ের অনুষ্ঠান একদিন হলেও বিয়ের পরে আড়াই নারী (বিয়ের পর দিন বরের বাড়িতে কনে পক্ষের লোকজন নাইওর আনতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে। ও হিরাইনারী (বিয়ের তৃতীয় দিন কনের বাড়িতে বর পক্ষের লোকজন নতুন বউ কে আনতে গিয়ে খাওয়া দাওয়ার করে) খাওয়া হয়। তাছাড়া পানচুনি ও গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানও যথারীতি পালন করা হয়। অনেক পরিবারে মুসলমানি বা সুন্নৎে খাতনা অনুষ্ঠান বড় করে করেন।
কোদালপুরের মানুষজন ধর্মীয় উৎসবে সাধ্য অনুযায়ী আনন্দে মেতে উঠে। ঈদের আগের দিন বিবাহিত মেয়েদের নাইওর আনা হয় এবং সাথে মেয়ের জামাইকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। সবচেয়ে যে জিনিষটি নজর কারে যারা বাড়ির বাহিরের দীর্ঘদিন অবস্থান করে তারা ঈদ উপলক্ষ্যে ঘরে ফিরে আসে। গ্রামের সন্তানেরা নাড়ীর টানে ঘরে ফিরে এসে পরিবারের সাথে ঈদ করে। তাছাড়া, স্বল্প পরিসরে সবে-বরাত, সবে কদর পালন করে থাকেন। অল্প কয়েক ঘর হিন্দুরাও তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান মহা ধুমধামে পালন করে থাকে।
ফসলঃ কোদালপুরে প্রধানত ধান, পাট, মরিচ ও সামান্য পরিমাণে গম উৎপন্ন হয়। শীতকালীন প্রচুর পরিমাণে শাকসবচি ফলে।রবি শস্যের মধ্যে প্রধানত কালিজিরা, সরিষা, ডাল ও ধনিয়া উৎপন্ন হয় বেশি।
এখানকার উৎপাদিত মরিচের মান অনেক ভালো। মরিচ কেনা বেচার জন্য অনেকগুলো নামকরা আড়ৎ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আড়ৎগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মেসার্স আলম মার্কা, বালুচর বাজার। কোদালপুরে উৎপাদিত মরিচ ঢাকার সামবাজারের প্রধান প্রধান আড়ৎে প্রেরণ করা হয়।

ঐতিহাসিক স্থান ও দর্শণীয় স্থানঃ কোদালপুর নদী ভাঙ্গন প্রবণ এলাকাও হওয়ার কারণে ঐতিহাসিক স্থান সেভাবে গড়ে উঠেনি।তবে কতগুলো স্থান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন; কোদালপুর জামে মসজিদ, কোদালপুর শিশু হাসপাতাল, কোদালপুর লঞ্চঘাট, বালুচর বাজার বেইলি ব্রিজ, হোসেন নূরীর দরগা শরীফ, আজিজ নূরীর দরগা শরীপ, কালার মাজার, আব্বাস মোল্লা এর ঘের, কোদালপুর হাইস্কুল ইত্যাদি।

বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব: সামছল মোল্রা, সোন মৃধা, হাজী আশ্রাফ আলী বেপারী, বাচ্চু ছৈয়াল, নজু শৈয়াল, আব্বাস মোল্লা, মিজানুর রহমান সরদার। ব্লগার সত্যের ছায়া, কবি- নকিব মুকসি।

পত্র পত্রিকাঃ কোদালপুর থেকে প্রকাশিত কোন পত্র পত্রিকা নেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে কোদালপুর নামে বিভিন্ন একাউন্ট ও পেইজ আছে।

পোষ্ট কোডঃ 8050

বাজারঃ কোদালপুর বাজারের আওতাধীন বালুচর বাজার একটি প্রসিদ্ধ বাজার। বালুচর বাজারে প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবারে হাট বসে।

ক্রীড়াঃ এখানকার মানুষ নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত হাডুডু, দারিয়াবান্দা, ডান্ডামারি (গাংগুলি) মার্বেল, নইমারী, সাতঘিট্টা, বারোঘিট্টা, ফুটবল ইত্যাদি খেলত। আর মেয়েরা কানামাছি, ঘইটা ঘইটা, বউ ছি ইত্যাদি খেলে সময় পার করত। 2000ইং সালের পর থেকে মানুষের অর্থনীতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে এবং শহরায়নের প্রভাব ঘটলে দেশীয় খেলাগুলো আস্তে আস্তে বিদায় নিতে থাকে। পরবর্তীতে শুধু ছেলেদের মাঝে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয়তা পায়।   
(আপডেট চলবে।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Recent Post

Sample Notice of Share Transfer

Intimation of Intended Share Gift by Mr. DK Khan, Managing Director,  ST Securities Limited