উক্ত প্রতিবাদ সভার পর ড্রেজার গংরা তাদের অবস্থান পরিবর্তণ করে আলাওলপুরের চরজালালপুর ও টেকপাড়ে অবস্থান নেয় এবং বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখে। ফলশ্রুতিতে আলাওলপুর ও চরজালালপুরের লোকজন ক্ষোভে ফেঁসে উঠে। এলেক্ষ্য চর জালালপুর ও টেকপাড় যুব সমাজ প্রচার প্রচারণা, মাইকিং ও ব্যানার ফেস্টুন প্রদর্শণ করেন। “চরজালালপুর সচেতন মহল” ব্যানারে গত ২৭ই জুন একটি মানব বন্ধনও আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ২৯শে জুন, ২০২২ সালে “চরজালালপুর সচেতন মহল” ও স্থানীয় যুব সমাজ মিলে নিজ উদ্যোগে ট্রলার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী ড্রেজার, বাল্কহেড গুলো চারদিকে ঘিরে ফেলে। সে সময় প্রতিবাদী জওয়ানরা নদীর তলদেশ রক্ষায় বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকনে। তাদের হাতে বিভিন্ন প্লেকার্ড শোভা পাচ্ছিল। বাহাউদ্দিন নাসিম নামের এক তরুণকে মাইকে বার বার বলতে শোনা যায়, “আপনাদের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই, আপনারা স-সন্মানে চলে যেতে পারেন। ” ড্রেজার কোম্পানী কোন উপায় না দেখে চরজালালপুর থেকে আপাতত সটকে পড়ে।
খবরে জানা যায় অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা বালু উত্তোলনের জন্য কয়েকটি পয়েন্টকে ব্যবহার করে। পয়েন্টগুলো হলো: কোদালপুরের ঠান্ডা বাজার, আবুল দর্জীর বাড়ীর পাশ, দক্ষিণ কোদালপুর, চরজালালপুর, টেকপার ইত্যাদি। তারা এক স্থানে প্রতিবাদ হলে অন্য স্থানে সটকে পড়ে, তাই এর জন্য সম্মলিত প্রতিবাদ দরকার।
এবার আসুন জেনে নেয়া যাক নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের উপর কি কি প্রভাব পড়ে:
অপরিকল্পত বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ এবং জীবজগতের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে। নদীর তলদেশ থেকে মাত্রাতিরিক্ত বালু উত্তোলন করলে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয় আবার কোথাও কোথাও জলপ্রবাহে হঠাৎ করে বেড়ে যায়।। এতে করে নদীর পাদদেশে ক্ষয় বাড়িয়ে তোলে। নদীর পাড় ভাঙান বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারণে নদী মাতৃক জনপদের অবকাঠামো, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু, ফসলি জমি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। প্রবাহমান নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন একই সঙ্গে পরিবেশ, সামাজিক ও বাস্তুসংস্থানজনিত নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে। খরস্রোতা ও নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আকম্মিক বন্যায় বসতভিটা হারিয়ে অনেক মানুষ অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হচ্ছে। দিন দিন নির্মাণ খাতে বালুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং এটি লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন একটি সংঘবদ্ধ অপরাধে রূপ নিচ্ছে। সাংবাদিক ভিন্স বেইসার এটিকে ‘স্যান্ড মাফিয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে অবৈধ ও অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন একটি নৈরাজ্য পরিবেশগত সংঘাতের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এবার দেখা যাক আইন কি বলে?
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ (২০১০ সালের ৬২ নং আইন) অনুযায়ী:
“ইজারা ব্যতীত বালুমহাল হইতে বালু বা মাটি উত্তোলন, ইত্যাদি ও রাজস্ব আদায় নিষিদ্ধঃ (১১) কোন বালুমহাল ইজারা প্রদান করা না হইয়া থাকিল, উক্ত বালুমহাল হইতে এই আইনের অধীন ইজারা প্রদান ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধতিতে বালু বা মাটি উত্তোলন, পরিবহণ, বিপণন ও সরবরাহ করা যাইবে না এবং এই মর্মে কোন রাজস্বও আদায় করা যাইবে না।”
“অপরাধ, বিচার ও দন্ডঃ ১৫। (১) এই আইনের ধারা ৪ এ বর্ণিত কতিপয় ক্ষেত্রে বালু বা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিধানসহ অন্য কোন বিধান কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অমান্য করিলে বা এই আইন বা অন্য কোন বিধান লংঘন করিয়া অথবা বালু বা মাটি উত্তোলনের জন্য বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করিলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ব্যক্তিবর্গ (এক্সিকিউটিভ বডি) বা তাহাদের সহায়তাকারী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ অনূর্ধ্ব ২(দুই) বৎসর কারাদন্ড বা সর্বনিম্ন ৫০(পঞ্চাশ) হাজার টাকা হইতে ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
(২) এই আইনের অধীন অপরাধ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ভ্রাম্যমান আদালত বা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচার হইবে।
(৩) Code of Criminal Procedure, 1898 এ নির্ধারিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অর্থদন্ড আরোপ সম্পর্কিত সীমাবদ্ধতা এই আইনের অধীন নির্ধারিত অর্থদন্ড আরোপে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা সীমিত করিবে না।
(৪) এই আইনের অধীন অপরাধ জামিনযোগ্য (Bailable), আমলযোগ্য (Cognizable) ও আপোষযোগ্য (Compoundable) হইবে
(৫) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত রায় বা আদেশ দ্বারা কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হইলে তিনি উক্ত দন্ডাদেশ প্রদানের ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে আঞ্চলিক অধিক্ষেত্রের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আপিল দায়ের করিতে পারিবেন এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে ৬০(ষাট) দিনের মধ্যে স্থানীয় অধিক্ষেত্রের দায়রা জজের আদালতে আপিল দায়ের করিতে পারিবেন।”
পরিশেষে, মেঘনা ও জয়ন্তী নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে চলছে বেপরোয়া বালু উত্তোলন। এর ফলে অনেক বড় বড় স্থাপনা ও সড়ক-মহাসড়ক হুমকির মুখে পড়ছে। এই অবৈধ বালু উত্তোলনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালীর ও রাজনৈতিক নামধারী নেতারা ব্যাপক আর্থিক লাভবান হলেও মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী ও নদীর তীরবর্তী জনগণ এবং সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমান রাজস্ব। তাছাড়া নদীর তীর রক্ষা ও ভাঙন রোধে আগামীতে সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল পরিমান অর্থ। তাই এখনি এই অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে স্থানীয় প্রশান, সরকার ও জনগণকে দুর্বার আন্দোলন ঘরে তোলা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই।
...................................
এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন