৭ই মার্চের ভাষণটি হলো ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রোজ রবিবার বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঢাকা শহরের রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে যেটা সোহওয়াদী উদ্যান নামে পরিচিত) অনুষ্ঠিত জনসভায় এক প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ। যা বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত। শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণটি ২:৪৫ মিনিতে আরম্ভ করে বিকাল ৩:০৩ সমাপ্ত করেন। উক্ত ভাষণে মোট শব্দ সংখ্যা ছিলো ১৩০৮টি এবং ভাষণটির ব্যাপ্তি ছিলো ১৮ মিনিট।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি
- ভাষণ প্রদান- ৭ মার্চ ১৯৭১।
- ভাষণ প্রদানের দন- রবিবার।
- ভাষণ প্রদানের সময়- ২:৪৫ থেকে ৩:০৩ (অপরাহ্ন)।
- বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেন- ১৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড/১৯ মিনিট।
- ভাষণ প্রদানের স্থান- রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়াদী উদ্যান)।
- রেসকোর্স ময়দানের অবস্থান- রমনা, ঢাকা।
- ৭ মার্চের ভাষণ অলিখিত।
- ৭ মার্চের ভাষণের শব্দ সংখ্যা ১৩০৮টি।
৭ মার্চের দফা- ৪টি, দফা চারটি হলোঃ ১। সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে ২। সেনা বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ৩। এই গণহত্যার তদন্ত করতে হবে। ৪। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
- ৭ মার্চ ভাষণে উপস্থিত জনসংখ্যা- ১০ লক্ষ।
- ৭ মার্চ ভাষণটি অনুবাদ হয়েছে- ১৩টি ভাষায়।
- ইংরেজী ভাষা ব্যতীত প্রথম অনুবাদ হয়েছে- জাপানি ভাষায়।
- ক্ষুদ্র নৃ তাত্ত্বিক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে- “কঁআথুয়েঁনঃ মাহাতো ডিকশনারি’ গ্রন্থ।
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়- নিউজউইক ম্যাগাজিন।
- ইউনেস্কো ৭ মার্চ ভাষণে স্কীকৃতি দেয়- ৩০ অক্টোবর ২০১৭ সালে, স্বীকৃতি দেয় “ডকুমেন্টারি হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে।
- ইউনেস্কো ৭ মার্চ ভাষণকে ‘মেমারি অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টা’ এ গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে সংগ্রহ করে রেখেছে।।
- ৭ মার্চ ভাষণের ভিডিও ধারণ করেন- অভিনেতা আবুল খায়ের।
- ৭ মার্চ ভাষণের অডিও ধরণ করেন- এইচ এন খোন্দকার।
- মাইকের নাম- কলরেডি।
৭ মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণঃ
‘ভায়েরা আমার-
আজ, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা- সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তারা আজ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? আপনারা নির্বাচনে গিয়ে নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে- আওয়ামী লীগকে আপনারা ভোট দ্যান, আমরা ভোট পাই। আমরা দেশের একটা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব। এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বত্সরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বত্সরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল-ল জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এ আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হল। আপনারা জানেন, দোষ কি আমাদের? আজকে তিনি, আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি, আপনারা জানেন আলাপ-আলোচনা করেছি। আমি পাক, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দ্যান। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে, তিনি মেনে নিলেন, মেনে নিলেন। তিনি তারপরে আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব। আমরা আলাপ-আলোচনা করব। আমি বললাম, বক্তৃতার মধ্যে, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।”
তারপরে জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়েত ইসলামীর নেতা নুরানি সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল, মুফতি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল, তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আসুন বসি, জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে ৬ দফা ১১ দফার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র করতে, একে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার ক্ষমতা আমার নাই। আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে আমাদের, আমাদের উপরে তিনি দোষ দিলেন এখানে আসলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, আমি ডাবল হোস্টেজ হতে চাই না। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তারপরেও যদি কেউ আসে তাকে ছান-নাছার করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হল।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাত্ বন্ধ করে দেওয়া হল, দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হল আমাকে যে, “আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্য তিনি তা করতে পারলেন না।” তারপরে বন্ধ করে দেওয়ার পরে এ দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দ্যান। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞবদ্ধ হল। কী পেলাম আমরা? আমাদের যাদের অস্ত্র নাই আমাদের হাতে। যা- আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, যখনই এ দেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই, আমি বলেছি তাদের কাছে এ কথা যে, আপনারা কেন আপনার ভায়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তা থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য।
তারপরে তিনি বললেন, যে আমার নামে বলেছেন, আমি নাকি বলে স্বীকার করেছি যে ১০ই তারিখে রাউন্ড-টেবল কনফারেন্স হবে। আমি তাকে এ কথা বলে দিবার চাই, আমি তাকে তা বলি নাই, টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, “জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান ঢাকায় আসেন কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তারপরে আপনি ঠিক করুন” আমি এই কথা বলেছিলাম।
তিনি বললেন আমি নাকি তাকে, তিনি নাকি খবর পেয়েছিলেন নাকি আমি তাকে আরটিসিতে বসব। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কীসের আরটিসি, কার আরটিসি, কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? আপনি আসুন, দেখুন জাতীয় পরিষদের জন্য আমার যারা রক্ত দিয়েছে সত্য কথা কিন্তু তা কি আপনারা দেখেছেন? তারপরে তিনি আজকে, আজকে আমার দেশ অ্যাসেম্বলির- আহা বসেন আপনারা, সিট ডাউন। অ্যাসেম্বলির তিনি ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি, এরপরে আপনারা জানেন আমি গেলাম, আমি গেলাম পল্টন ময়দানে, আমি বললাম সবকিছু বন্ধ। সরকারি অফিস বন্ধ, আহা ভাইরা আপনার স্টপ প্লিজ। আমি বললাম, আমার কথা সকলে মানল, সকলে আমাকে বলল এবং আপনারা আমাকে যে সে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনারা, আমি বললাম কোনো সরকারি অফিস চলবে না, কোনো কিছু চলবে না। আমি কিছু কিছু জনগণের কষ্ট হয় সেটা স্লাক করলাম। যে এই এই জিনিস চলবে, ঠিক সেভাবে চলল। হঠাত্ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন এবং যে বক্তৃতা করে অ্যাসেম্বলি করেছেন- সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন। আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের। তিনি বাধা দিলেন যে আসতে পারবা না, গোলমাল হল না পশ্চিম পাকিস্তানে, গুলি করে মারা হল আমার বাংলার মানুষকে। আমি পরিষ্কার মিটিংয়ে বলেছি, “এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি ঐ শহীদের রক্তের উপর দিয়ে পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম সামরিক আইন মার্শাল-ল উইথ-ড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কী পারব না। এর পূর্বে, এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসা, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দ্যায় নাই।
ভায়েরা আমার,
তোমরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি- প্রধানমন্ত্রিত্ব- আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই
না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আপনারা জানেন, আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে
দেওয়ার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি এবং শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের, গরিবের যাতে কষ্ট না হয়,
গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য যে
জিনিসগুলি আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল
চলবে, সব চলবে লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট
তারপরে আর কি সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে
কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি
চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়- তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল,
প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা
করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও
পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই,
তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি
চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।
আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।
আজ আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে, আমাদের আওয়ামী লীগ অফিসে রিলিফ কমিটি করা হয়েছে, যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যেসব শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, সান্ধ্য আইনের জন্য যোগদান করতে পারেন নাই- প্রত্যেকটা, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। মনে রাখবেন। আর সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন সেক্রেটারিয়েটে, হাইকোর্টে বা জজকোর্টে দেখা না হয়। দ্বিতীয় কথা যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল- কেউ দেবে না।
আপনারা আমার উপর ছেড়ে দ্যান, আন্দোলন কী করে করতে হয়। শোনেন মনে রাখবেন, একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে ছদ্মবেশে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়- হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, দ্বিতীয় কথা হল এই যে, যদি আবার কোনো রকমের কোনো আঘাত আসে, আমি যদি হুকুম দেওয়ার না পারি, আমার সহকর্মীরা হুকুম দেওয়ার না পারে, মনে রাখবেন আরেকটা কথা অনুরোধ করছি রেলওয়ে চলবে সত্য কথা। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোকদের কোনো জায়গা থেকে, এক জাগা আরেক জাগা নেবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে আমি দায়ী হব না। প্রোগ্রামটা বলছি আমি, শোনেন, রেডিও, টেলিভিশন, নিউজ পেপার। মনে রাখবেন রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। রেডিও যদি আমাদের নিউজ না দেওয়ার দেয় কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। টেলিভিশনে যদি আমাদের নিউজ না দেওয়া হয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশন অফিসে যাবেন না। ২ ঘণ্টার মতো ব্যাক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন। আমার কিছু বলার থাকবে না, দরকার হয় চাকা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
ভায়েরা আমার-
আমার কাছে, এখনই শুনলাম আমার এই বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি আপনারা
আমার প্লেয়ার চালায়ে দেন, কারো হুকুম মানতে পারবেন না। তবে আমি অনুরোধ করছি আপনারা
আমাদের ভাই, আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনো
দিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবে না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফায়সালা করতে
পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই, ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য আপনাদের
অনুরোধ করছি, আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না।
দ্বিতীয় কথা প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক
সাব-ডিবি-সনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। এবং তোমাদের যা কিছু
আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এই দেশের
মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ভায়েরা আমার-
যেভাবে আপনাদের, আপনারা ঠাণ্ডা হবেন না, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জালেম আত্মা আরম্ভ করবে
আক্রমণ করতে। আপনারা হুঁশিয়ার থাকবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। পজিশন চলবে, কিন্তু মনে
রাখবেন, ডিসিপ্লিন সোলজার ছাড়া, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোনো জাতি জিততে পারে না। আপনারা
আমার উপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন, জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে
বেঈমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই, ফাঁসি-কাষ্ঠের আসামি
দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা একদিন আমাকে জেলে থেকে বের করে
নিয়ে এসেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, “আমার রক্ত দিয়ে, আমি রক্তের ঋণ
শোধ করব।” মনে আছে? আমি রক্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, আমাদের মিটিং এখানেই শেষ।
আস্-সালামো ওয়ালাই-কুম।
জয় বাংলা’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন