মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২২

লালবাগ কেল্লা পরিচিতি- Sotterchaya

লালবাগ কেল্লা। মোগল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত স্মারক। যার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসক শায়েস্তা খাঁ এর নাম। আজও   প্রাচীরে কান পাতলে অনুভব করা যায় মোগল সৈন্য সামন্তের অস্ত্রের ঝনঝনানি, কিংবা কণ্যা পরি বানুর মৃত্যুতে পিতা শায়েস্তা খানের অঝোর কান্না, অথবা মগ জলদস্যু নিয়ন্ত্রণের জন্য শায়েস্তা খানের কামানের গর্জণ। চলুন আজ লালবাগ কেল্লা থেকে একটু ঘুরে আসি।

লালবাগ কেল্লা পরিচিতি
নামঃ লালবাগ কেল্লা।
পূর্ব নামঃ কেল্লা আওরাঙ্গবাদ।
বর্তমান নামঃ লালবাগ কেল্লা।
নামকরণ করেনঃ শাহ আজম।
নির্মাণ সালঃ ১৬৭৪ এবং ১৬৮০ থেকে ১৬৮৪। মোট ৫ বছর।

নির্মাতা ও নির্মাণ ইতিহাসঃ আজম শাহ (মোগল সম্রাট আরঙ্গজেব এর ৩য় পুত্র) ১৬৭৪ সালে বাসস্থান হিসেবে ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে এই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। দুর্গটি এক বছর নির্মাণধীণ অবস্থায় সম্রাট আরঙ্গজেব মারাঠা বিদ্রোহ দমন করার জন্য কুতুব-উদ-দীন মুহাম্মদ আজমকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। আজম শাহ্ নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রেখেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য দিল্লিতে চলে যান। এ সময়ের মধ্যে তিনি একটি দরবার হল এবং একটি মসজিদ নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে মুঘল ফরমানে শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ঢাকায় গর্ভণর নিযুক্ত হন। শায়েস্তা খাঁ বঙ্গ প্রদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী প্রদেশে রুপান্তর করেন, যার সুফল বঙ্গের মানুষ পলাশী যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ভোগ করেছেন। শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে আজম শাহ এর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য হাত দেন। শায়েস্তা খাঁ  এক নাগারে চার বছর ধরে উক্ত দুর্গের নির্মাণ কাজ চলমান রাখেন। কিন্তু ১৬৮৪ শায়েস্তা খানের কণ্যা পরী বিবির অকাল মূত্যুর কারণে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কি কারণে পরী বিবির মৃত্যু হয়েছে তা আজও অজানা। কিন্তু পরী বিবির মৃত্যুর কারণে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়নি তা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। পরী বিবির মৃত্যুতে শায়েস্তা খাঁ মানুষিকভাবে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। হয়ত তিনি প্রিয়তম কণ্যাকে হারানোর বেদনা ভুলতে পারেনি। তাই তিনি দুর্গের নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরী বিবিকে দরবার হলের পিছনে (পশ্চিম পাশে) এবং মসজিদের সামনে (পূর্ব পাশে) সমাহিত করা হয়। অনেকে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন যে, পরী বিবির অকাল মৃত্যুর জন্য শায়েস্তা খাঁ  দুর্গের অশুভ শক্তিকে দায়ী করেছেন এবং নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছেন। কিন্তু তাদের একথার পক্ষে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ইহা অনুমান নির্ভর। মানুষ ফ্যান্টাসি শুনতে পছন্দ করে তাই একথা ছড়ানো হয়েছে।

দরবার হলঃ লালবাগ কেল্লার আকর্ষণীয় স্থাপনা হলো দরবার হল। দরবার হলের পূর্ব নাম ছিলো দিয়ানি আম। আগেই বলা হয়েছে দরবার হলটি নির্মাণ করেছিলেন শাহ আজম। কিন্তু এই দরবার হলে বসে তিনি বেশি দিন রাজকীয় কর্ম পরিচালনা করতে পারেনি। হয়ত বসার আগেই দিল্লি চলে গেছেন। পরবর্তীতে সুবেদার শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে বঙ্গীয় রাজকার্য পরিচালনা করছেন। দরবার হলটি দ্বি-তল বিশিষ্ট, পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নিচ তলায় থেকে উপরে ‍উঠার জন্য সিঁড়ি রয়েছে। নিচ তলায় ছিলো হাম্মামখানা (গোসলখানা) এবং বাস ভবন। উপর তলায় ছিলো শায়েস্তা খাঁর প্রশাসনিক ও বিচারিক কার্য। এখান থেকেই শায়েস্তা খাঁ মোগল শাসকদের পক্ষ হয়ে ফরমান জারি করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ নবাবদের অধীন চাকুরী থেকে অবসর নেন এবং  আগ্রা চলে যান। ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে তিনি দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করে দিয়ে যান। পরবর্তীতে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। বর্তমানে দরবার হলটি জাদুঘরে রুপান্তর করা হয়েছে। হলের ভিতরে মুগল আমলের অনেক নিদর্শণ দেখতে পাবেন। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের পোশাক, যুদ্ধাস্ত্র, প্রচলিত মুদ্রা দেখলে আপনাকে কল্পনায় শায়েস্তা খাঁর আমলে নিয়ে যাবে।


সংস্কারঃ সংস্কার কাজ সম্পর্কে যে দলিল দস্তাবেজ পাওয়া যায় তা নিম্নরুপঃ-  
(ক) ১৮৪৪ঃ বৃটিশ আমলে 'ঢাকা কমিটি' নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়নমূলক কাজ করেন। তখনকার সময় থেকেই আওরাঙ্গবাদ কেল্লা নাম পরিবর্তিত হয়ে দুর্গটির নতুন নাম হয় লালবাগ দুর্গ।
(খ) ১৯১০- লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে চলে যায়।
(গ)১৯৮০ দশকে- লালবাগ দুর্গের সংস্কার করে যথাসম্ভব এর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয় হয়।
(ঘ) বর্তমানে (২০২২) সালে দরবার হলের সংস্কার কাজ চলমান আছে। দরবার হলের পশ্চিম পাশে মুজিব কর্ণার নামে একটি কর্ণার স্থাপন করা হচ্ছে।

পরী বিবির মাজারঃ পরী বিবি ছিলেন শায়েস্তা খাঁ'য়ের কণ্যা। তার আসল নাম ইরান দুখত রহমত বানু। তার বিয়ে হয়েছিলো শাহজাদা আজম শাহের সাথে। শাহজাদা আজম শাহ ছিলেন আরঙ্গজেব এর তৃতীয় পুত্র। তাদের বিয়ে হয় ১৬৮৮ সালে, আর মৃত্যু বরণ করেন ১৬৮৪ সালে। অপর একটি মতে, পরী বিবির সাথে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের আগেই পরী বিবি মারা যান, তারপর পরী বিবিকে দরবার হলের পিছনে (পশ্চিম পাশে) এবং মসজিদের সামনে (পূর্ব পাশে) সমাহিত করা হয়। তবে প্রথম মতটি সঠিক বলে প্রমাণিত। এটি একটি সামাধি কক্ষ। এতে সর্বমোট নয়টি কক্ষ রয়েছে। মোট আয়তন ২০.২ মিটার, দেখতে বর্গাকৃতির। প্রবেশপথ তিনটি। মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বাহারি রঙের ফুল-পাতার সুশোভিত মুগ্ধকর টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলোর ছাদ কষ্টি পাথরের তৈরি। লোকমুখে প্রচলিত আছে উপরের গম্বুজটি এক সময় স্বর্ণখচিত ছিল, তবে এখন তা তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদান করা হয়েছে। 


খোদাবন্দ (মির্জা বাঙ্গালীর) সমাধিঃ শায়েস্তা খানের একান্ত বিশ্বস্ত সহ-সেনা অধিনায়ক। খোদাবন্দ এর কবরের দুই পাশে দুটি শিশুর কবর রয়েছে। কবরের দুই শিশুর পরিচয় অজ্ঞাত। ধারণা করা হয় তারা অভিজাত পরিবারের কেউ। এই সমাধি তিনটি পরী বিবির মাজারে দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত।

তিন গম্বুজ বিশিষ্ট শাহী মসজিদঃ এই মসজিদটি লালবাগ কেল্লা মসজিদ নামে পরিচিত, কেউ কেউ শাহী মসজিদও বলে থাকেন। যাতে গম্ভুজ রয়েছে তিনটি। যার আয়তন ১৯.১৯ মি: × ৯.৮৪ মি। এর নির্মাতা সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র শাহজাদা আজম। নির্মাণ সাল ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দ।

সদ্য আবিস্কারঃ লালবাগ দুর্গের অভ্যন্তরে খনন কার্যের ফলে মোগলদের ব্যবহার্য দ্বিস্তর বিশিষ্ট একটি পঁয়নিষ্কাশন লাইন (ড্রেন) আবিস্কার হয়েছে। পয়নিষ্কাশন ড্রেনটি দক্ষিণ পশ্চিমপাশে শাহী মসজিদ লাগোয়া, যা বুড়িগঙ্গা নদীতে মিশেছে।

দক্ষিণ-পূর্ব তোরণঃ লালবাগ কেল্লার স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শণ এর দক্ষিণ-পূর্ব তোরণ। এতে রাজকীয় জৌলুস বিদ্যমান। সুউচ্চ তিন তলা তোরণটির  সম্মুখ ভাগের শীর্ষে দু’দিকে দুটি সরু মিনার দ্বারা সুশোভিত রয়েছে আট কোণাকার টারেট। ভেতর দিকে দু’পাশে দুটি সিঁড়ি দিয়ে ওপড়ে ওঠার ব্যবস্থা আছে। তোরণের উভয় দিকে প্রবেশের জন্য বড় আকারের খিলান দরজা। এর ছাদের তলদেশ অর্ধ গম্ভুজ আকৃতি। ভেতর অংশ কক্ষের আদলে তৈরি। দুপাশে ছোট প্রহরী কক্ষ। চূড়ার চার কোণায় চারটি মিনারের ওপরে ছোট আকৃতির গম্ভুজ ছিল। বর্তমানে এদের দুটির অস্তিত্ব আছে।


পানির ফোয়ারাঃ পরি বিবির মাজারে সামনে সুবিশাল পানির ফোয়ারা রয়েছে। মাঝেমধ্যে বিশেষ উপলক্ষ্য হিসেবে এই ফোয়ারা চালু করা হয়। 

বাগানঃ সম্পূর্ণ দূর্গটিকে সুবিশাল  বাগানের মাধ্যমে সজ্জিত করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফুল গাছ শোভা পাচ্ছে, যা দর্শণার্থীদের কাছে আকর্ষণীয়। 

সুরঙ্গঃ লালবাগ কেল্লায় একটি গোপন সুরঙ্গ রয়েছে। আগে দর্শণার্থীদের জন্য কিছুটা খোলা থাকলেও এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। অনেকে ধারণা করেন সুরঙ্গ বুড়িগঙ্গা ওপারে গিয়ে শেষ হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন দিল্লির রাজ দরবারের সাথে গিয়ে শেষ হয়েছে। ইহা কল্পণা মাত্র। 

টিকেটঃ এখন পর্যন্ত অনলাইনে টিকিট কাটার কোন ব্যবস্থা নাই। তবে কেল্লার উক্তর পশ্চিম পাশে একটি টিকেট কাউন্টার রয়েছে। প্রতি টিকেট মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য বিশ টাকা। পাঁচ বছরের কম বয়েসি শিশুদের জন্য কোন টিকেট দরকার নেই। বিদেশেীদের জন্য প্রবেশ মূল্য দুইশত টাকা মাত্র।


সময় সূচি

গ্রীষ্মকালঃ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত আধ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ থাকে।

শীতকালঃ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা । দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ ।
শুক্রবারঃ ১২:৩০ – ৩:০০ পর্যন্ত বন্ধ।
রবিবারঃ সাধারণ ছুটি।
সোমবার বেলা  ২.০০ থেকে  লালবাগ কেল্লা খোলা থাকে।

ভ্রমণ গাইডঃ পুরাণ ঢাকার আজিমপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে নেমে ১০ মিনিটের মধ্যে রিক্সা দিয়ে লালবাগ কেল্লায় যাওয়া যায়। ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেক বাবু বাজার দিয়েও লালবাগ আসা যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Recent Post

Proposal for Sale of Commercial Lands- Sotterchaya