পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২

রুদ্রকর মঠ, শরীয়তপুরের প্রাচীন ঐতিহাসিক নির্দশণ।



শিল্পীর দৃষ্টিতে প্রাচীনকালে প্রতাপশালী রুদ্রকর জমিদার বাড়ি ও মঠ দেখতে এরকমই ছিল।
শরীয়তপুর জেলার প্রাচীন নির্দশন গুলোর মধ্যে রুদ্রকর মঠ অন্যতম। রুদ্রকর মঠটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ঐতিহাসিক হিন্দু মন্দির। অনেকের কাছে  জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। এই ঐতিহাসিক মঠঠি শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে এবং মনোহরদী বাজারের কাছে শরীয়তপুর- ভেদরগঞ্জ মহাসড়কের অতি নিকটে অবস্থিত। রুদ্রকর মঠের উত্তরে পার্শ্বে জমিদার বাড়ি এবং দক্ষিণপ্রান্তে চরআটং। পূর্ব প্রান্তে বুড়িরহাট বাজার অবস্থিত। একেবারে পশ্চিমে আংগারিয়া বাজার এবং উত্তর পশ্চিমে শরীয়তপুর পুলিশ লাইন মাঠ। মঠের একেবারে সামনের দিকে রয়েছে একটি বড় পুকুর। ধারণা করা হয় মঠ নির্মাণের সময় পুকুরটি খনন করা হয়েছে। পূজোর সময় অনেক হিন্দু আশেকানে ভক্ত উক্ত পুকুরে গোসল করতে আসেন। 
রুদ্রকর মঠকে দূর থেকে দেখতে এরকম দেখায়। মঠের সাথে পুকুর দেখা যাচ্ছে।

সময়কাল ও প্রতিষ্ঠাতাঃ রুদ্রকর মঠটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির। মন্দিরে খোদাই করা প্রস্তর লিপি থেকে জানা যায়, গুরুচরণ চন্দ্রবর্তী নামক একজন হিন্দু ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি নিজের ঐকান্তিক ইচ্ছায় মঠটি ধীরেধীর গড়ে তোলেন। অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির ধারণা, মঠটি বাংলার নবাব আলিবর্দী খানের আমলে (আনুমানিকঃ ১৩১৩-১৩১৫ বঙ্গাব্দে) নির্মাণ করা হয়েছে।

মঠ নির্মাণে যে মিথ জড়িয়ে আছেঃ  তৎকালীন অত্র অঞ্চলের জমিদার বাবু গুরুচরণ চন্দ্রবর্তীর প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি রাশমনির সমাধিকে অমর করে রাখার ‍উদ্দেশ্যে উক্ত মঠটি নির্মাণ করেন। তবে রাশমনির সাথে মঠের প্রতিষ্ঠাতা গুরুচরণ চক্রবর্তীর কি সম্পর্ক ছিল তা ভালোভাবে জানা যায়নি। কেউ কেউ রাশমনিকে গুরুচরণ চক্রবর্তীর ‘মা’ বলে থাকেন। মঠ নির্মাতা জমিদার পরিবারটিকে নীলমনি চক্রবর্তী নামে একজন ব্যক্তি গোড়াপোত্তন করেন। তবে এই নীলমনি চক্রবর্তী  এখানে (শরীয়তপুরে) কোথা থেকে এসেছেন এবং তার পূর্ব পুরুষ কোন অঞ্চলের আদি বাসিন্দা ছিল তার সঠিক ইতিহাস বের করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়রা ধারণা করেন, রুদ্রকর জমিদার পরিবারটি পদ্মার উত্তর পারে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জের আদি বিক্রমপুর থেকে এসেছেন। মঠটি বিভিন্ন সময় অল্প পরিসরে সংস্কার করা হলেও ১৮৯৮ সালে বড় আকারে পুনঃনির্মাণ করা হয়। সংস্কারের পর অদ্যাবধি তার আসল কাঠামো ঠিক আছে। জমিদার বাড়ি এবং মঠটি তের একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।

মূল বর্ণনাঃ রুদ্রকর জমিদার বাড়িতে প্রবেশ পথে প্রথম ফটকে আপনার একটি লেখা নজরে আসবে, সেখানে লেখা রয়েছে ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ ও নীলমনি চক্রবর্তী মহাশয়কৃত দালানের পুনঃসংস্কার ১৮৯৮ বঙ্গাব্দ”। নীলমনি চক্রবর্তী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়িতে বর্তমানে তিনটি দালান অবশিষ্ট আছে। এই তিনটি ভবনের দুটি  তিন তলা বিশিষ্ট এবং বাকি একটি একতলা বিশিষ্ট, যা এখনো অবিকল অবস্থায় বিদ্যমান। স্থানীয় প্রবীণদের বর্ণনা অনুযায়ী, জমিদার বাড়িতে প্রায় দশটি সু-উচ্চ ভবন ছিল। ভবনগুলো ছিলো পাশাপাশি অবস্থিত। এই ভবনগুলো মঠ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনতলা ভবনগুলো ছিল জমিদার পরিবারের আবাসস্থল। বাকীগুলো ছিলো দরবার হল, গুদামঘর,  রন্ধনশালা, নৃত্যশালা ও চাকরবাকরদের জন্য একটি নির্ধারিত ভবন। মঠের পাশে আরেকটি ভবনছিল যেটি প্রার্থণা ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে তার অস্তিত্ব একেবারেই নেই। প্রচলিত আছে যে, জমিদার বাড়িতে মাটির নিচে কয়েকটি গোপন কুঠরী ঘর ছিল, যা মাটির নিচে চাপা পড়ে রয়েছে। অনেকের ধারণা মাটি খুড়লে কুঠিগুলোর অস্তিত্ব অবিকল উদ্ধার করা সম্ভব।


মঠটির গঠণশৈলী অপূর্ব। অনেক দূর থেকেও মঠের মিনার দৃশ্যমান হয়। ভিতরেও বাহিরে সমকালীন অসাধারণ কারুকাজ বিদ্যমান। মূল স্থাপত্যে অসাধারণ সব শৈল্পিক নির্মাণ চোখে পড়বে। মঠের মূল অংশে আনন্দ জায়গা নামের একটি অংশে প্রাচীনকাল থেকে টিয়া পাখিরা বসবাস করে আসছে। অনেকে এই টিয়া পাখিকে সৌভাগ্য এবং আনন্দের প্রতীক মনে করেন। পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হলো এই টিয়াপাখি। এখানে খুব কাছ থেকে টিয়া পাখির প্রাকৃতিক বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। টিয়া পাখির ডাকে অনেকে বিমোহিত হন। 

মঠটির মূল অংশে রয়েছে একটি স্মাশান মন্দির। স্মাশান মন্দিরটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে আরো চারটি ছোট আকৃতির মন্দির, যা বড় মন্দিরের বারান্দার সাথে লাগোয়া। এই ছোট মন্দিরগুলো মূল মঠের অংশ বিশেষ এবং মঠের গঠন আকৃতির ও সৌদয্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। স্মাশান মন্দির বা বড় মঠটির উচ্চতা ২০ মিটার এবং ছোট মন্দিরগুলো উচ্চতা কমবেশি ১.৯৫ মিটার। সু-উচ্চ মন্দিরের পার্শ্বে চারটি ছোট ছোট মন্দিরের মিনার থাকায় মঠটির শ্রী বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। তাছাড়া স্মাশান মন্দিরের (বড় মঠটির) তয় তলার গায়ে চারটি দেবীর অলংকরণ রয়েছে। যা হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধানীয় এবং পবিত্র বস্তু হিসেবে বিবেচিত।

মঠের আশেপাশের পরিবেশ অত্যান্ত নিরিবিলি এবং প্রাকৃতিক ছায়া নিবিরঘেড়া থাকার কারণে আলাদা একটা আত্মাধিক ভাব বিরাজ করে। স্থানীয় ব্যক্তিরা এই মঠটি নিয়ে গর্ব করে থাকেন। সকল ধর্মের মানুষ মঠটির পবিত্রতা এবং সংরক্ষণের ব্যাপারে খুবই যত্মশীল। এখানকার মানুষের পরমত সহিষ্ণুতা যুগযুগ ধরে বিদ্যমান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে শরীয়তপুর আলাদা স্থান দখল করে আছে।

রুদ্রকর জমিদার পরিবারের লোকেরা তাদের আওতাধীন এলাকায় বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তার মধ্যে রাস্তা ঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্যতম। জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমনি চক্রবর্তী নামে রুদ্রকর ইউনিয়নে একটি বিদ্যালয় আছে; যা ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর রুদ্রকর জমিদার পরিবারের শেষ জমিদার প্রথম লাল চক্রবর্তী সপরিবারে ভারতে চলে যান।

বর্তমান অবস্থাঃ এক সময়কার প্রতাপশালী রুদ্রকর জমিদার পরিবার অত্র অঞ্চল থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের গড়া অধিকাংশ ভবন সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে। মঠটি হিন্দুদের প্রার্থনার স্থান হওয়ার কারণে এখনো কোনমতে টিকে আছে। তবে সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে মঠের গায়ে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সেই গর্তে পাখিরা নিরাপদ বাসস্থান বানিয়েছে। সামনের দিনে মঠটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়তে পারে, বিশেষ করে ঘূীর্ণঝড় কিংবা ভূকম্পন হলে। তাছাড়া মঠটির কিছু কিছু পুনঃনির্মাণ করা দরকার। যদি সরকারী ব্যবস্থাপনায় মঠটি পুনঃ নির্মাণ করা হয় তাহলে এর আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে এবং এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। এব্যাপারে স্থানীয় রাজনৈতিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসতে পারেন। তারা যদি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে পারেন তাহলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এগিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে নৌ পথ এবং সড়ক পথে শরীয়তপুরে যাওয়া যায়। তবে স-পরিবারে গেলে নৌপথে ভালোভাবে যেতে পারেন।

নৌপথেঃ  ঢাকা সদর ঘাট থেকে শরীয়তপুর, ওয়াপদাঘাট, নড়িয়া, ভোজেশ্বর, সুরেস্বর, ভেদরগঞ্জ, লাউখোলা, ডামুড্যা, গোসাইরহাটে লঞ্চ যায়। শরীয়তপুর কিংবা ওয়াপদা ঘাটে নামলে সেখান থেকে মটর সাইকেল, বেবি ট্যাক্সি, ইজিবাইক, টমটম, ভ্যান প্রভুতি দিয়ে রুদ্রকর মঠে যেতে পারবেন।

সড়ক পথেঃ বরিশাল এবং দক্ষিণবঙ্গের মানুষ মাদারীপুরের মোস্তাকপুর হয়ে বাস যোগে শরীয়তপুরে যাতায়াত করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে মনোহর বাজার বাস স্টান্ড নামতে হবে।
ঢাকা হতে যারা যাবেন তারা গুলিস্তান থেকে ইলিশ, গাংচিল, প্রচেষ্টা পরিবহনে মাওয়া ঘাটে নেমে লঞ্চ কিংবা স্পিড বোটে অথবা ফেরিতে পদ্মা নদী পার হয়ে মাঝিঘাটে নামবেন, সেখান থেকে বাস কিংবা মটরসাইকেলে শরীয়তপুর যাওয়া যায়। তাছাড়া পদ্মা সেতু চালু হওয়ার এখন যাত্রাবাড়ী ও গুলিস্তান থেকে বাসে করে সরাসরি শরীয়তপুর যেতে পারবেন।


এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন