মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনে পাল্টে যাচ্ছে শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার মানচিত্র। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি, প্রবল স্রোতে ও অতিবর্ষনের কারনে সর্বনাশা মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে বিগত দিনে উপজেলা ৩টি ইউনিয়নের অন্তত ২৫ গ্রামের কয়েক শত পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
বিলীন হয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি, ইউপি স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ অনেক স্থাপনা। অনিশ্চিত হচ্ছে বিদ্যালয়গামী শত শত শিশু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। গোসাইরহাট উপজেলা সংলগ্ন মেঘনা নদীর পাড় সংলগ্ন প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় বাধ না দিলে উপজেলার মূল ভূখন্ডের একটি বিশাল অংশ মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
সরেজমিন পরিদর্শন করে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২৫ বছরে প্রতি বর্ষায় থেমে থেমে মেঘনার সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন চলতে থাকে। এতে কোদালপুর, আলাওলপুর (সাবেক গরীবের), কুচাইপট্টি ইউনিয়নে অনেক অংশ মেঘনার মুখে গ্রাস করে নিয়েছে। নদী ভাঙ্গার কারণে গোসাইরহাটের সাথে হাইমচর উপজেলার ৮টি পয়েন্টে সীমানা বিরোধ রয়েছে। এ সীমানা বিরোধের কারণে অত্র এলাকায় ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার সহিংস ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর এ সীমানা বিরোধের কারণে হাইমচরের ঈশানবালা ও নিউচর এলাকায় ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। তখন সীমানা বিরোধপূর্ণ এলাকার মানুষ একে অপরের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শতাধিক ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, লুটপাট করে এমনকি নারী ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। তাছাড়া বরিশালের হিজলা (মুলাদীর) সাথে সীমান্ত বিরোধের কারণে কুচাইপট্টি ইউনিয়নের নির্বাচনও সাময়িক বন্ধ ছিল। যদিও পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তথাপি ভবিষ্যতে সীমানা বিরোধ আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই এলাকার সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং অবকাঠামোর টেকসই উন্নয়নের জন্য নদীর পাড়ে বাঁধের কোন বিকল্প নেই।
যেখানে হতে পারে বাঁধঃ আলওলপুর ইউনিয়নের চরজালালপুরের শেষ সীমান্ত (ইশানবালা) থেকে আরম্ভ হয়ে কোদালপুর ইউনিয়ন হয়ে কুচাইপট্টি ইউনিয়নের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সমীক্ষা চালিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং মাস্টার প্লান প্রনয়ণ করে দ্রুত নদীর পাড় রক্ষা বাঁধ (River embankment protection wall) নির্মাণ করা যায়। এতে পাশ্ববর্তী দুই উপজেলার সাথে সীমান্ত বিরোধ দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে মীমাংসা হবে। আর যদি বাঁধ নির্মাণ না হয় তাহলে গোসাইরহাটের মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে এবং যে কোন সময় আবারো ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটার আশংকা রয়েছে।
তাই উপরোক্ত বিষয়টি মাথায় রেখে গোসাইরহাট নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের সদয় দৃষ্টি কার্যকর পদক্ষেপ কামণা করছি। বিষয়টি অতীব জরুরি।
বাধ নির্মাণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতিঃ
গোসাইরহাটের মেঘনা নদীর পাড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ইতিমধ্য অনেক রাজনৈতিক নেতা দিয়েছেন; তার মধ্যে সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী (প্রয়াত) আব্দুর রাজ্জাক অন্যতম। তার নির্বাচনী জনসভা কোদালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে উক্ত বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে সময় তার এ প্রতিশ্রুতি কোদালপুরবাসী ব্যাপক কড়তালির মাধ্যমে স্বাগত জানায়। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় হলো তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর অসুস্থ্যতা জণিত কারণে ইন্তিকাল করেন (খোদা তাকে বেহস্তবাসী করুক)। ফলশ্রুতিতে সে প্রতিশ্রুতিটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে গোসাইরহাটবাসী এখনোও বিশ্বাস করে রাজ্জাক সাহেব বেঁচে থাকলে উক্ত বাঁধ এত দিনে নির্মাণ হয়ে যেত, জনগণ রক্ষাপেত নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে।
গোসাইরহাটের নদীর পাড় রক্ষা আন্দোলনের বর্তমান অবস্থাঃ যতটুকু জানা যায়, সর্ব প্রথম লিখিত আকারে( অনলাইন) বাঁধ নির্মাণের দাবি তোলেন শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া) নামের একজন ফেসবুক ইউজার। তিনি ২০১৫ সালে ফেসবুকে একটি বিশদ বিবরণ সম্মিলিত পোষ্ট করেন। সে সময় পোষ্টটি ব্যাপক ভাইরাল হয়। তারই ধারা বাহিকতায় চরজালালপুর সর্বদলীয় যুব ঐক্যফোরাম এর ব্যানারে গোসাইরহাটকে মেঘনার ভাঙন থেকে রক্ষার দাবিতে আলাওলপুর ইউনিয়নের চরজালালপুরে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ও মতবিনিময় সভা করেছে স্থানীয় জনগণ। আগষ্ট ১২, ২০২২ সালে চরজালালপুর টেকপাড় বাজার সরদারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে কয়েক শতাধিক নারী-পুরুষ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন আলাওলপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বাচ্চু সরদার, আবুল হোসেন দর্জি, মনসুর মাদবর, ইঞ্জিনিয়ার কবির আহমেদ, বাবুল বেপারী, রেজওয়ান আহমেদ ঢালী, ফখরুল ইসলাম প্রমুখ। অন্যান্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন যুব ঐক্যফোরামের অন্যতম সমন্বয়ক, শাহনূর শাহীন, শাহপরান, মহীউদ্দীন বাবর, ওসমান গনী লিটন, বাহাউদ্দীন নাসিম, সাইফুল ইসলাম, ডিএম ফয়সাল প্রমুখ। এসময় বক্তারা চরজালালপুরকে মেঘনার ভাঙন থেকে রক্ষায় অবিলম্বে বাঁধ নির্মাণের জোড়ালো দাবি তোলেন।
শেষ কথাঃ বাঁধ নির্মাণের দাবিটি অনেক আগেই তোলা উচিত ছিলো। তবে আশার কথা হলো আলাওলপুরের জনগণ বিষয়টি বিলম্বে উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। এখন সময় হয়েছে আলাওলপুর বাসীর সাথে কোদালপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিয়নের জনগণের একাত্মা প্রকাশ করা। প্রয়োজনে গোসাইরহাট উপজেলায় মানবন্ধন কর্মসূচি পালনকরা। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের নিকট বিষয়টি জোড়ালোভাবে উপস্থাপন করতে পারলেই নদীতে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হবে।
***
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন