রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২

বিলুনিয়ার প্রথম যুদ্ধ, একই ফ্রন্ট লাইনে পাকিস্তানিদের বারো বার পরাজয়ের গ্লানিকর ইতিহাস।

যুদ্ধের ফর্মেশনঃ

১নং সেক্টরের অধীন সৈন্য সমাবেশঃ  ভারত থেকে বিলোনিয়া প্রবেশ- ১ নম্বর সেক্টরের নিয়মিত ও স্বল্পপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব দিক থেকে প্রবেশ করবে। 

পরিকল্পনা মোতাবেক ১-নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের ১ জুন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানির সমন্বয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম, পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) নেতৃত্বে বিলোনিয়ার পূর্ব সীমান্তে চাঁদগাজীর সামান্য দক্ষিণ দিক দিয়ে বিলোনিয়াতে প্রবেশ করবেন, তিনি এ প্রবেশ সমাপ্ত করেন ১৯৭১ সালের ৩ জুনের মধ্যে।

মুহুরী নদীর সংলগ্নে অবস্থান নেওয়া কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল)। মাঝের কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। ভারত সীমান্তসংলগ্ন কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পরে মেজর)। মেজর জিয়া চাঁদগাজীর নিকটবর্তী স্থানে সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করেন এবং ১নং সেক্টরের কমান্ড গ্রহণ করেন।

২নং সেক্টরের অধীন সৈন্য সমাবেশঃ ২ নম্বর সেক্টরের নিয়মিত ও স্বল্পপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চিম দিক থেকে বিলোনিয়ার দক্ষিণ মুখে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত  গ্রহন করা হয়। ২ নম্বর সেক্টরের মক্তিযোদ্ধারাও চারটি কোম্পানিতে বিভক্ত হয়ে পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে নোয়াপুর-জাম্মুরা হয়ে বিলোনিয়াতে প্রবেশ করেন এবং পশ্চিমের আন্তর্জাতিক সীমানা হতে মুহুরী নদী পর্যন্ত দক্ষিণমুখী হয়ে তিন কোম্পানিকে সম্মুখে এবং এক কোম্পানিকে পেছনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন।  

মেজর জেনারেল ইমাম-উজ জামান, বীর বিক্রম মুহুরী নদীর সংলগ্ন সাধারণ এলাকা পূর্ব রশিকপুরে   কোম্পানি অবস্থান নিবে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) তার অধীনস্থ্য কোম্পানি নিয়ে  রশিকপুরের  মাঝ বরাবর ডিফেন্স লাইন গড়ে তুলেবে। 

ক্যাপ্টেন গাফফার হালদার (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) পশ্চিম দিকে আন্তর্জাতিক সীমান্তসংলগ্ন সাধারণ এলাকা জাম্মুরাতে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকবে।

লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরী (পরে মেজর)। তিনি তার কোম্পানি নিয়ে সর্ব পিছনে অস্থান নিবেন। যাতে পচ্ছাৎ দিক থেকে আক্রমণ আসলে ঠেকানো যায়। 

মর্টার প্লাটুনটি পেছনের কোম্পানির নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান নিবে, যাতে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সবদিকে ফায়ারিং সার্পোট দেয়া যাবে। উল্লেখ্য যে ২ নম্বর সেক্টরের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এ জে এম আমিনুল হক (বীর উত্তম, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)।

মূল যুদ্ধঃ জুনের ৩ তারিখের মধ্যে ১ ও ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা ফর্মেশন অনুযায়ী সম্মলিতভাবে বিলোনিয়া অবস্থানের  প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে বিশদ ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করে এবং সেই অনুযায়ী বন্দুয়া-দৌলতপুর রেললাইন ও ছাগলনাইয়া থেকে উত্তর দিকে চলে যাওয়া রাস্তা বরাবর দুটি অক্ষে অগ্রসর হয়ে এক আকস্মিক আক্রমণ করার পরিকল্পনা হাতে নেয়।

পাকিস্তানিরা ভেবেছিল ফ্রন্ট লাইনে কিছু অপ্রশিক্ষিত ও নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে, তাদের এই আত্মগাফেলতি ও অসতর্কতার কারণেই যুদ্ধের প্রথম দিনে মুক্তিবাহিনীর রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথেই ভারী মেশিনগান এবং অন্যান্য প্রচলিত অস্ত্রের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে প্রায় ৬০ ও ৭০ জন পাকিস্তানি সেনা তাৎক্ষণিক নিহত হয়। এতে করে পাকিস্তান সেনা বাহিনী বুঝে যায় মুক্তি বাহিনীর  প্রতিরক্ষা অবস্থানটি দুর্বল নয় এবং তারা সেখানে শক্ত ডিফেন্স গড়ে তুলেছে। ফলে সেদিনকার মতো তাদের পিছু হটা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরবর্তীতে তাদের লোকবল ও ফায়ারিং সাপোর্ট বৃদ্ধি করে ৭ জুন, ১৯৭১ সালের ভোরে উল্লিখিত দুটো পথে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। অভিযানের প্রথমে তারা মুক্তিবাহিনীর অগ্রসর কমান্ডের সামনে পড়ে কচুকাটা হয়, বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ সফলতার সঙ্গে প্রতিহত করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অভিযানে ৫০ থেকে ৬০ জন সেনা হারায়। 

পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনা বাহিনী তাদের রণ কৌশল পরিবর্তণ করে ৯ জুন তারিখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার সমগ্র সম্মুখভাগজুড়ে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে। পাকিস্তান সেনা বাহিনী তাদের অভিযানে এক ব্যাটালিয়ানের বেশি সেনা শক্তি ব্যবহার করে এবং সারা দিন ব্যাপী মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। এ সময় পাকিস্তানি এক রেজিমেন্ট গোলন্দাজ ইউনিট  ফেনী ও ছাগলনাইয়ার মধ্যবর্তী স্থান হতে সার্পোট দেয়। শত্রুর এ সম্মিলিত প্রচেষ্টাও মুক্তিবাহিনী ব্যর্থ করে দেয়। এপর্যায়ে এসে মু্ক্তি বাহিনী তাদের সম্মুখ ভাগ অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম-১৬ মাইন বসায়।   

বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধে মুক্তি বাহিনী ও পাক বাহিনীর সামরিক বিন্যাস।

১১ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুনরায় সংগঠিত হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ব্যাপক গোলা বর্ষণ শুরু করে, কিন্তু মুক্তিবাহিনী তাদের সে আক্রমণও প্রতিহত করে দেয়। প্রতিরোধ যোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ১১জুন পর্যন্ত বিলুনিয়া ডিফেন্স লাইন ভাঙ্গার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ১১ বার নিষ্ফল আক্রমণ চালায়। তারা দিন-রাত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলোর ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। পরিশেষে শত্রুরা বুঝতে পারে যে এভাবে আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ধ্বংস করা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে তারা ছোটখাটো সংঘর্ষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স লাইন বরাবর ফায়ারিং অব্যহত রাখে।

১৭-২১ জুন : ১৭ জুন ভোরেই শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণপূর্ব ভারী গোলাবর্ষণ (Pre H Hour Bombardment )শুরু করে। একই সঙ্গে শত্রুর রিকয়েললেস রাইফেল (আরআর), ৮১ মিমি মর্টার, হেভি মেশিনগান ইত্যাদির ব্যাপক গোলাগুলি বর্ষণও চলছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্রোতের মতো শত্রুর পদাতিক আক্রমণ শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিটি ট্রেঞ্চ থেকে শত্রু বাহিনীকে অটোমেটিক ও সেমি অটোমেটিক অস্ত্রে ফায়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রতিহত করতে থাকল। এ ছিল একটি অসমযুদ্ধ। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে শত্রুর ব্রিগেডটি একের পর এক আক্রমণ চালালেও প্রতিবারই পর্যুদস্ত হতে লাগল। এভাবে সাত ঘণ্টা পর শত্রুর আক্রমণ থেমে গেল ও তারা পিছু হটে গেল। তাদের মৃতদেহগুলো বিলোনিয়া নদীর ধারে পড়ে রইল। পরে মুক্তি বাহিনী জানতে পারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান, যিনি সে সময় ঢাকায় সফরে এসেছিলেন, তিনি নিজে ফেনীতে উপস্থিত থেকে দুজন ব্রিগেডিয়ারের সহায়তায় এই আক্রমণটি পরিচালনা করেন। তাদের ধারণা ছিল, বিলোনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানটি মূলত 'মুজিবনগর' ও এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মাত্র। তাই তারা এমন মরিয়া হয়ে এই আক্রমণটি পরিচালনা করেছিল। এই যুদ্ধে একটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেয় ৮ ম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের মেজর আশিফ, যাকে ক্যাপ্টেন এইচ এম আব্দুল গাফ্ফার (বীর উত্তম) অত্র যুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার, কুমিল্লায় চাকরির সুবাদে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। যা-ই হোক, ১৭ জুনই মেজর খালেদ মোশাররফ খবর পাঠালেন যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল অরোরা মুক্তিযুদ্ধাদের অবস্থান দেখতে আসতে পারেন। যেহেতু তিনি হেলিকপ্টারে আসবেন, সেহেতু মুক্তিযুদ্ধারা  যেন কোনো হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি না চালায় । কিন্তু কেন জানি জেনারেল অরোরা এলেন না। ১৮ জুন থেকে ২০ জুন সারা দিন যুদ্ধের একটি অঘোষিত বিরতি চলল। এ যেন আরেকটি বড় ঝড়ের আগে থমথমে ভাব। ২০ জুন সারা দিন ও রাত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুরে ক্যাপ্টেন গাফফার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাংকারে গেল। বিকেলের মধ্যে ক্যাপ্টেনদ্বয় তাদের অধীনস্থ সব প্লাটুন কমান্ডারকে ডেকে পাঠায় এবং তাদের অতিরিক্ত নজরদারির করার দির্দেশ দেন। 

ক্যাপ্টেন গাফফার হালদার (বীর উত্তম)

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপত্তার খাতিরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে কোনো বাতি জ্বালালেন না । সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন গাফফার বাংকারে বসে দুটো রুটি ডাল দিয়ে খেতে বসেছেন, তখনই তিন সহ কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পেলেন। দুটি হেলিকপ্টার কমান্ড পোস্টের পেছন দিকে উড়ছে, যা কিনা প্রতি অবস্থানের উত্তর- পশ্চিম দিক তথা ভারতের দিক থেকে এসেছে। ক্যাপ্টেন গাফফার ভাবলেন, প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের জন্য জেনারেল অরোরা হয়তো আগে আসতে পারেননি। আজ বৃষ্টির মাত্রা খানিকটা কম দেখে তিনিই বুঝি -বা এসেছেন। এই চিন্তা করে কীভাবে জেনারেলকে অভ্যর্থনা জানাবে তাই তিনি ভাবতে থাকলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন হেলিকল্টারগুলো প্রথমে একসঙ্গে খুব নিচু দিয়ে কিছু দূর উড়ে হঠাৎ করেই তারা দুদিকে চলে যাচ্ছে । এরপর হেলিকপ্টার দুটি ফেনীর দিকে কিছু দূর গিয়ে আবার দক্ষিণ দিক থেকে তাদের ডিফেন্স লাইন বরাবর দিকে এগিয়ে আসছে। একটি হেলিকপ্টার বাঁম দিক থেকে প্রতিরক্ষা অবস্থানের পূর্ব দিকে এবং অন্যটি বাংকারের ওপর দিয়ে উড়ে উত্তর দিকে প্রায় ১ হাজার গজ পর্যন্ত চলে যায় । তখন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন জাফরের সন্দেহ জাগে, হেলিকপ্টার দুটি দুই জায়গায় নামছে কেন? তাই তিনি তার অধীনস্থ সাপোর্ট প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার শহীদকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠান। এর ১৫ মিনিটের মধ্যে আবার দেখা যায় হেলিকপ্টার দুটি ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে এবং তারপর হঠাৎ বাঁ ও পেছন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর গ্রেনেড, ভারী ও হালকা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফার বুঝতে পারেন যে, এগুলো জেনারেল অরোরার হেলিকপ্টার নয়, বরং শত্রুর স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (SSG) বা কমান্ডো বাহিনীর কাজ। পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে অবস্থান নেওয়ার মানেই ছিল যে সামনে থেকেও শত্রুর বড় ধরনের আক্রমণ তখন অত্যাসন্ন। ক্যাপ্টেন গাফফার তার অধীনস্থ সুবেদার শহীদ এবং ইপিআরের সুবেদার ফরিদ আহমেদকে তৎক্ষণাৎ তাদের অধীন সকল সৈনিককে ফ্রন্ট লাইন বরাবর এক জায়গায় এবং কাছাকাছি  জড়ো করার নির্দেশ দেন।

ঘটনার পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা এক যায়গায় পাশাপাশি ডিফেন্স লাইন গড়ে তোলেন। তারা প্রধান রাস্তা এবং রেললাইনের উঁচু আড়ের ওপরে অবস্থান নিল। এই ডিফেন্সসিভ যুদ্ধে ক্যা্প্টেন গাফফার তার অধিন্যস্থ সহ-অধিনায়ক (Second -in-Command বা 2IC) সুবেদার খুরশিদ আলমকে উত্তর ও পশ্চিম দিকে নজর রাখার নির্দেশ দেন। তিনি নিজে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে নজর রাখতে থাকলেন। এ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের এক চরম পরীক্ষার রাত। একটু ভুল করলেই বাহিনীর সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম খবর পাঠালেন যে তিনি এফডিএলের ওপর দিয়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য  এগোচ্ছেন। তিনি যেন ভুল বুঝে ফায়ার না করেন।

 

ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম

পাকিস্তানি বাহিনী তাদের গোলন্দাজ ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র, যেমন আরআর, মর্টার ও হেভি মেশিনগানের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করতে শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের প্রতিরক্ষা এলাকার সব স্থানেই পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকলেন।এভাবে প্রায় দুইঘণ্টা পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ওপর গুলিবর্ষণ করে। পাকিস্তানীরা এ পর্যায়ে বেশি সুবিধা করতে না পেরে ইতিমধ্যে হেলিকপ্টার হতে পুনরায়  তাদের কমান্ডো সৈন্য পিছনে নামিয়ে গেল। নিকষ অন্ধকার রাতে মুক্তিযোদ্ধারা হেলিকপ্টারগুলো দেখতে পারছিলেন কিন্তু ফায়ারিং এর আওয়াজের কারণে কপ্টারের আওয়াজ শুনতে পারছিলেন না। রাত নয়টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্টে খবর আসল যে লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের অবস্থান পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। সেদিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দও শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। অন্য দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার সেকশন কমান্ডার সুবেদার জব্বার জানাল যে তার মর্টারগুলো আর ফায়ার সহায়তা দিতে পারবে না। কারণ, তার গোলা ফুরিয়ে গিয়েছে। ইমামুজ্জামান ফিল্ড টেলিফোনে ক্যাপ্টেন গাফফারকে জানাল যে পাকিস্তানি কমান্ডোরা তার অবস্থানের সামনে থেকে প্রচন্ড আক্রমণ চালাচ্ছে এবং তারা পাঠাননগরের দিকে এগোচ্ছে। সে আরও জানাল যে তার কাছে গোলাবারুদ ফুরিয়ে এসেছে। তাই ক্যাপ্টেন গাফফার যেন তার মজুত থেকে সত্বর কিছু গোলাবারুদ পাঠায়। সে আরও জানাল, ছাগলনাইয়া থেকে মুহুরী নদীর পারে আমাদের যে প্রতিরক্ষাটি ছিল তা সন্ধ্যায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু যোগাযোগের অভাবে সেটা ক্যাপ্টেন গাফফারকে আগে জানাতে পারেনি। প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে পড়ায় সে ফুলগাজীর দিকে সরে যাচ্ছে। এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন গাফফার ডান পাশের বাহিনীর অবস্থান তুলে নিয়ে মুহুরী নদী হয়ে ফুলগাজীতে নতুন অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। রাত নয়টার দিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের কমান্ড সেন্টারটি পাকিস্তানি কমান্ডোদের আক্রমণের শিকার হয়। পাঠাননগর হয়ে অগ্রসরমাণ শত্রুসেনারা বাঁ দিক এবং সামনের দিক থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থানের ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম টেলিফোনে ক্যাপ্টেন গাফফারকে জানায় যে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ আমাদের অবস্থান তুলে নিয়ে ফুলগাজীর পেছনে চিতলিয়ায় অবস্থান নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন । এই আদেশটি ছিল খুবই সময়োচিত। কারণ, তা না হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পুরো ইউনিট সমূলে ধ্বংস হয়ে যেত। পাকিস্তানি কমান্ডো ও অন্য পদাতিক সেনারা আস্তে আস্তে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। রাতের আবছা আলোছায়ায় শত্রুরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তযোদ্ধাদের দিকে আসছে। প্রতি দলে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। তখন বাঁ দিকের শত্রুদলটি ২০-২৫ গজ এবং সামনের দলটি ৩০-৪০ গজ দূরে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে হুংকার দিয়ে শত্রুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে প্রায় আধা ঘণ্টা গোলাগুলি, গ্রেনেড ছোড়াছুড়ি আর বেশ খানিকটা হাতাহাতি লড়াইয়ের পর শত্রুপক্ষের উভয় দল মোট আটটি মৃতদেহ ফেলে রণে ভঙ্গ দিয়ে পেছনে সরে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোতে দ্রুত বেয়নেট চার্জ করে নিজ নিজ জায়গায় ফিরে এসে অবস্থান নেয়। সেদিনের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন গাফফারের কমান্ড পয়েন্টে মুক্তিযুদ্ধাদের পক্ষে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা কমবেশি আহত হয়। এই সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দুজন গুরুতরভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদবর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে পৌছানোর দ্রুত কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই  ১৪ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে পাশের পাকা ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। খালেদ মোশাররফের ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক মেজর আমিনুল হক (বীর উত্তম, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) এ সময় ফুলগাজী থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থানে এলেন। গাফফার তার অবস্থানের দ্রুত অবনতির কথা তাকে জানান। মেজর আমিনুল হক (বীর উত্তম)আহত সৈন্যদের ফুলগাজী- চিতলিয়াতে স্থানান্তরের দায়িত্ব নিলেন। আহত সৈন্যদের এই দলকে নিরাপদে পৌছানোর জন্য একটি ছোট ফাইটিং প্যাট্রোল গঠন করে তাদের কে এসকর্ট পার্টি হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়।

রাত তখন দশটা, যুদ্ধ কিছু সময়ের জন্য থেমে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড পোষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে শত্রুরা তখন তাদের সৈন্যদের পুনরায় সংগঠিত করছে পরবর্তী আক্রমণের জন্য। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা কিছু গোলাবারুদ পুনর্বণ্টন করা হয়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর কোম্পানির সৈন্যদের সাথে নিয়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের সাথে একত্র হলেন। গোলা বারুদের কমতি ও দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তারা দুজনেই একমত হলাম যে ক্যাপ্টেন গাফফার তার অবস্থান আরে কিছু সময় ধরে রাখবে এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর বাহিনী নিয়ে ফুলগাজীতে পশ্চাদপসরণ করবেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ২১ জুন ভোর চারটার মধ্যে ধাপে ধাপে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সব সৈন্য ফুলগাজীর দিকে চলে যায়। পুরো'  কৌশলগত পশ্চাদপসরণ '(Withdrawal)- টি খুব সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। ফুলগাজীতে মেজর খালেদ মোশাররফ অবস্থান করছিলেন। ফুলগাজী সেই সময়ও ছিল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখান থেকে শত্রুকে কৌশলগতভাবে বাধা কষ্ট সাধ্য ছিলো বিধায় চিতলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্টর কমান্ডারের আদেশমতো চিতলিয়াতে সরে যাওয়ার আগে ফুলগাজী ব্রিজটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং সেখানে একটি ‘ডিলেইং পার্টি’ রাখা হয়। চিতলিয়াতে পৌঁছেই মুক্তিযোদ্ধারা নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করলেন। ক্যাপ্টেন গাফফার তার কোম্পানি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলাবোর্ড সড়ক এবং রেললাইনের ওপরে অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর বাহিনী নিয়ে পরশুরাম এলাকায় অবস্থান নিলেন। লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান তাঁর বাহিনী নিয়ে মুহুরী নদীর পাড় ধরে তাঁর প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলেন। এভাবেই দ্রুত চিতলিয়ার ডিফেন্স গড়ে উঠে।  

সূত্রঃ✔️ স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন- এইচ এম আব্দুল গাফ্ফার, বীর উত্তম।

✔️ মেজর জেনারেল ইমাম-উজ জামান (বীর বিক্রম) কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রকাশিত নিবন্ধন।

✔️ সংগ্রামের নোটবুক

✔️ইউকিপিডিয়া।

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।

এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Recent Post

Proposal for Sale of Commercial Lands- Sotterchaya