পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

গোসাইরহাট উপজেলা পরিচিতি- সত্যের ছায়া

নামকরণঃ গোসাইরহাট উপজেলার নামকরণের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়না। গোসাইরহাট উপজেলাটি নদী বিধৌত এলাকা। এই এলাকাটি এক সময় চর বা চরাঞ্চল ছিলো। প্রাচীনকালে অত্র এলাকায় প্রচুর গরু এবং মহিষ চড়ানো হতো।

এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘোষ পদবি বিশিষ্ট একটি কায়স্থ গ্রাম ছিলো। এই ঘোষদের প্রধান পেশা ছিলো চরে বা মাঠে গরু চরানো। অপরদিকে এখানকার মুসলমান সম্প্রদায় গবাদি পশু সস্তা ও সহজ লভ্যতার কারণে কসাইখানা গড়ে তোলেন। কসাইখানে থাকার কারণে এলাকাটির নাম হয় গোসাই, পরবর্তীতে নির্দিষ্ট দিনে হাট বসার কারণে গোসাই এর সাথে হাট শব্দটি সংযুক্ত হয়ে গোসাইরহাট হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, আগে গোসাই শব্দটি দ্বারা কসাইখানা বুঝানো হত।

তবে, অনেকের ধারণা করেন, নবাব আলীবর্দী খান এবং বাংলা বিহার ইড়িষ্যাড় শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলার সম সাময়িক আমলে বর্তমান গোসাইরহাট থানার মূলগাঁও গ্রামটির নিকট ব্রহ্মনন্দ গিরি নামে এক সাধু সন্ন্যাসী  বাস করতেন। লোকে তাকে  ‘গোসাই’ নামে ডাকতেন। গোসাই হতেই গোসাইরহাট নামকরণ হতে পারে, তবে তা অনুমান নির্ভর। এর কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমান পাওয়া যায়না। কেননা ১৭৫৭ সাল বা তার কয়েক বছর আগে পরে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি (সাধূ সন্ন্যাসী) মারা গেলে উক্ত ব্যক্তির নামে ঔ এলাকাটির নামকর করা হয়। বাংলাদেশে এর বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু, ব্রক্ষনন্দ গিরি নামের সাধু ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর মূলগাঁও গ্রামটির নাম পরিবর্তন হয়ে গোসাই হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। তাছাড়া উক্ত ব্যক্তির নামে যদি গ্রাম বা স্থান পরিচিতি পায় তাহলে ব্রহ্মনন্দ বা গিরি নামে হওয়ার কথা ছিলো তাও হয়নি। ১৯৮৩ সালে গোসাইরহাটকে উপজেলায় রুপান্তর বা প্রতিষ্ঠা করার সময় উক্ত ব্যক্তির নামে উপজেলাটির নাম গোসাইরহাট রাখা সন্দেহযুক্ত।

আবার, অনেকের মতে, প্রাচীন ইদিলপুর পরগনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কায়স্থদের পদবিশেষ একটি গোষ্ঠি যথা গোষ সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। ঘোষ শব্দ থেকে পরিবর্তিত রুপ হয়ে ঘোষাই (গোয়ালা, ঘোষের দুধ) বা গোসাই হয়েছে। এই ঘোষ সম্প্রদায় ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট স্থানে বসে দুধ বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে হাটের ধারণা আসলে ঘোষের সাথে হাট বসে ঘোষাইরহাট বা গোসাইরহাট হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ঘোষ এর বাংলা অর্থ, গোয়ালা, গোয়ালদের পাড়া, গোপপল্লিতে যাওয়া, কায়স্থ এবং সদগোপ শ্রেণির বাঙালি হিন্দুর পদবি বিশেষদের পাড়া ইত্যাদি। ঘোষ সম্প্রদায়ের প্রাণ পুরুষের  সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো যোগেশচন্দ্র ঘোষ, সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।  বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কালী প্রসন্নঘোষ ও অত্র এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন।

অপরদিকে, গোঁসাই শব্দটি গোস্বামী শব্দের কোমল রূপ। গো মানে পৃথিবী। স্বামী মানে প্রভু। এতে বুঝা যায় এই এলাকায় ঘোষ বা গোসাইদের বিশেষ প্রভাব ছিলো।

ভৌগলিক অবস্থানঃ শরীয়তপুর জেলার সর্বদক্ষিণ পূর্বকোণে গোসাইরহাট উপজেলা অবসিহত।  তৎকালে ৭টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এ গোসাইরহাট উপজেলা।  বর্তমানে ৮টি ইউনিয়ন এ গোসাইরহাট উপজেলার অন্তর্ভুক্ত।  এ উপজেলার উত্তরে ডামুড্যা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে বরিশালের হিজলা-মুলাদী উপজেলা, পূর্বে চাঁদপুরের হাইমচর এবং পশ্চিমে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা। 

যোগাযোগ ব্যবস্থা

সড়ক পথঃ গোসাইরহাট উপজেলার সড়ক ব্যবস্থা তত উন্নত নয়। পিচ ঢালাই রাস্তা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। শরীয়তপুর সদর থেকে গোসাইরহাট উপজেলায় যাওয়া যায়, দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। গোসাইরহাট থেকে বর্তমানে বিআরটিসি বাস পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার গুলিস্তান আসা যাওয়া করে। আবার গোসাইরহাট থেকে সড়ক পথ শরীয়তপুর সদর হয়ে জাজিরাপ্রান্ত দিয়ে মাঝিরঘাট আসা যায়। মাঝিরঘাট (মাওয়াঘাট) পার হয়ে  মাওয়ার মুন্সিগঞ্জ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা আসা যাওয়া করা যায়। গোসাইরহাট থেকে হাটুরিয়া হয়ে বরিশালে যাতায়াত করা যায়। গোসাইরহাট বাজার থেকে মটর সাইকেল অটো গাড়ি করে কোদালপুর- আলাওলপুর হয়ে ইব্রাহিমপুর ফেরিঘাট দিয়ে চাঁদপুর- ঢাকা যাতায়াত সহজ। 

নদীপথঃ গোসাইরহাট থেকে প্রতিদিন ঢাকামুখী আওলাদ, সোনারতরী লঞ্চ ছেড়ে যায়। আবার ঢাকার সদর ঘাট থেকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় লঞ্চ গোসাইরহাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। গোসইরহাট থেকে ওয়াপদা লঞ্চঘাট, চন্ডিপুর লঞ্চঘাট এবং সুরেশ্বর লঞ্চঘাট দিয়ে নদী পথে ঢাকা (সদরঘাট) যাওয়া যায়। নদী পথে ট্রলারে করে চাঁদপুর, বরিশালের মুলাদী স্বল্প খরচে যাতায়াত করা যায়।
রেলপথঃ গোসেইরহাট চরাঞ্চল ও নদীমাতৃক হওয়ার কারণে রেলপথ গড়ে উঠেনি।

অর্থনীতিঃ পূর্বে গোসাইরহাট উপজেলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর ছিলো। এখানকার প্রধান প্রধান ফসলগুলো হলো ধান, পাট, মরিচ, শরীষা, গম, পিয়াজ, ধনিয়া, কালোঝিরা, আখ, পান ইত্যাদি। পূর্বে উল্লেখ সংখ্যক জেলে পরিবার ছিলো। বর্তমানে অর্থনীতির গতিপথ পাল্টিয়েছে। অনেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। প্রবাসী আছেন উল্লেখ সংখ্যক মানুষ। প্রাইভেট কোম্পানী ও সরকারী চাকুরীতি তরুণ প্রজন্ম আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। অনেকে আবার উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। তরুণ প্রজন্মের অনেকে ঢাকা মুখী হয়েছেন।

প্রশাসনিক কাঠামোঃ গোসাইরহাট উপজেলার প্রশাসনিক কাঠামো দুটি ভাগে বিভক্ত। তার মধ্যে ১টি পৌরসভা এবং ৮টি ইউনিয়ন। পৌরসভাঃ গোসাইরহাট পৌরসভা। ইউনিয়ন সমূহ হলোঃ গোসাইরহাট ইউনিয়ন, সামন্তসার ইউনিয়ন, নাগেরপাড়া ইউনিয়ন, নলমুড়ি ইউনিয়ন, আলাওলপুর ইউনিয়ন, কুচাইপট্টি ইউনিয়ন, ইদিলপুর ইউনিয়ন, কোদালপুর ইউনিয়ন
 

ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত স্থানঃ

হাটুরিয়া জমিদার বাড়ি।

হাটুরিয়া জিনের মসজিদ।

গোসাইরহাট ব্রিজ

সাইক্ষ্যা ব্রিজ।

কোদালপুর দরবার শরীফ

ইদিলপুর খানকায় কাদেরিয়া শরীফ

বালুচর বেইলি ব্রিজ

কোদালপুর কালার মাজার শরীফ

পট্টি লঞ্চঘাট

খেলাধূলা ও চিত্তবিনোদন/সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড
খেলাধূলাঃ গোসাইরহাট উপজেলাটি নদীমাতৃক ও চরাঞ্জল হওয়ার কারণে এখানে খেলাধূলায় গ্রামীণ ও বৈচিত্র লক্ষ করা যায়। নব্বই দশকে গ্রামীন খেলার আধিক্য ছিলো বেশি। তারমধ্যে হাডুডু, বউছি, কানামাছি, দাড়িয়াবান্দা, পুতুল খেলা, বাঘ ছাগল, মার্বেল, লাঠিম, মোরগ লড়াই, লুডু, ঘোলগুট্টি, এক্কাদোক্কা, ঘুড়ি উড়ানো, নই মাড়ি, ডাংগুলি (ডান্ডা খেলা) ইত্যাদি অন্যতম। বর্তমানে, ক্রিকেট, ফুটবল, দাবা জনপ্রিয় খেলা।তাছাড়া তরুণ প্রজন্ম মোবাইল ও কম্পিউটার গেমে আসক্ত হচ্ছে। গোসাইরহাট উপজেলায় প্রতিটি ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভালো মানো খেলার মাঠ আছে, তার মধ্যে আলাওলপুর, কোদালপুর, ইদিলপুর পাইপলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ এবং সামছুর রহমান ডিগ্রি কলেজ মাঠ উল্লেখযোগ্য। 

চিত্ত বিনোদন বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডঃ প্রাচীনকালে গোসাইরহাটে যাত্রাপালা, নাটক, ঝাড়িগান, বিয়েতে গীত গাওয়া, পালাগান ব্যাপক প্রচলন ছিলো। তাছাড়া উড়স শরীফ, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি ছিল চখে পড়ার মতো। বর্তমানে চিত্তবিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সেভাবে প্রচলিত না থাকলেও সরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিচালিত হয়, বিশেষ করে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানগুলো মহাধুমধামে চলে।

নদ-নদীঃ গোসাইরহাটের চারপাশে নদনদী সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। গোসাইরহাট উপজেলার পূর্বপ্রান্ত (কুচাইপট্টি, কোদালপুর, আলাওলপুর) দিয়ে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ নদী তথা মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। মেঘনার নদী থেকে মোট তিনটি নদী উৎপন্ন হয়ে গোসাইরহাট উপজেলার প্রবেশ করেছে। তারমধ্যে সর্ব দক্ষিণে কুলচারি পাতার চর থেকে একটি শাখা এবং দাইমি কোদালপুর থেকে আরেকটি শাখা উৎপন্ন হয়ে গোসাইরহাট লঞ্চঘাটে মিলিত হয়ে ‘জয়েন্তি’ নাম ধারণ করেছে। গোসাইরহাট উপজেলায় জয়েন্তি নদী একটি বিখ্যাত নদী। এখানে উল্লেখ্য যে, দাইমি কোদালপুর থেকে যে শাখাটি উৎপন্ন হয়েছে তার উপর মাইজারা ব্রিজ অবস্থিত। অপরদিকে গোসাইরহাটের উত্তর কোদালপুর (ঠান্ডা বাজার) থেকে আরেকটি নদী উৎপন্ন হয়ে বালুচর বাজারের প্রান্ত ঘেঁষে কোদালপুর ট্রলারঘাট (উকিল নগর) হয়ে ডামুড্যায় জয়েন্তি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। তাছাড়া গোসাইরহাট উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে ছোটখাট খাল রয়েছে। অনেক খাল মেঘনা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়েছে আবার অনেকগুলো সরকারী অর্থায়নে খনন করা হয়েছে। গোসাইরহাটের নদীতে পূর্বে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে মাছের পরিমাণ কমে আসছে।

প্রখ্যাত বা বিখ্যাত ব্যক্তি

১। আলহাজ্জ শামসুর রহমান, প্রতিষ্ঠাতাঃ সরকারি সামসুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর, পরিচালক, বে-গ্রুপ।

২। গীতা দত্ত, বিশিষ্ট গায়িকা, হিন্দী চিত্রে প্লে-ব্যাক গায়িকা ও ফিল্ম রেকর্ডের গায়িকা।

৩। যোগেশচন্দ্র ঘোষ, প্রতিষ্ঠাতা, সাধনা ঔষধালয়।

৪। অতুল প্রসাদ সেন, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।

৫। মো: আখতার হোসেন, সিনিয়র সচিব, মাননীয় মন্ত্রী- জননিরাপত্তা বিভাগ।

৬। ব্লগার শাহাদাৎ হোসাইন, প্রতিষ্ঠাতা,সত্যেরছায়া ব্লগ।

 


এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন