পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০২২

শিশু যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন- যৌন নির্যাতনের কারণ, নির্যাতন বা নিপীড়নকৃত শিশুদের আচরণ এবং কিভাবে যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় চোখ রাখলে প্রতিদিন অসংখ্য শিশু নির্যাতনের খবর আসে।এই খবর এতই ভয়াবহ যে মাঝেমধ্যে গা শিউরে উঠে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ শিশুর যৌন হয়রানি ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে। এই তালিকায় পরিবারের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং স্কুল ও মক্তবের শিক্ষক পর্যন্ত রয়েছে।বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসায় পায়ুকামিতা এখন আতঙ্কের নাম এবং নিয়মিত খবরে প্রকাশিত হচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি'র সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, একটি জড়িপ ও গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছেন যে, শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনার শতকরা ৭৫ ভাগ ঘটনা ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে৷ 

মেয়ে শিশুদের মধ্যে তা প্রতি চার জনে একজন এবং ছেলে শিশুদের মধ্যে প্রতি ছয় জনে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়। পুরুষরাই প্রধানত যৌন হয়রানিকারী, তবে নারীদের বিরুদ্ধেও এখন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ শিশুদের যৌন হয়রানি ঘটনার স্থানগুলো হলো নিজ বাড়িতে, আত্মীয়ের বাড়িতে, স্কুল ও মাদ্রাসায়, স্কুল মাদ্রাসায় আসা যাওয়ার পথে। শিশুদের যৌন হয়রানির তালিকায় যারা আছেন তাদের তালিকা দেখলে আপনার গা শিউরে উঠবে, এক্ষেত্রে বড় ভাইয়ের বন্ধু, চাচাত, ফুফাত, খালত ও মামাতো ভাই অথবা বোন, সোসাইটি বা সামাজিক চাচা অর্থাৎ বাবার বন্ধু, ফুফু, প্রাইভেট শিক্ষক, গেটের পাহাড়াদার, কাজের লোক এরকম আরো অনেকে তালিকায় আছে। নিকট আত্মীয় যেকোন ব্যক্তির দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

শিশু যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন কি?

শিশুদ যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন বলতে সাধারণত যখন একটি শিশুর সাথে যৌন কার্যকলাপ প্রদর্শণ যেমন: হস্তমৈথুন করা, অশ্লীল কথোপকথন, ফোন কল, টেক্সট মেসেজ বা ডিজিটাল ইন্টারঅ্যাকশন শিশুদের পর্নোগ্রাফিকস ছবি বা সিনেমা দেখানো বা শেয়ার করা, যৌন ক্রিয়া সম্পাদন যেমন যোনি, বুক, মুখ বা পায়ুপথে যেকোন ধরণের যৌনতা আচরণ এবং যৌন প্রচার যেমন নিজেকে প্রকাশ করা, হস্তমৈথুন করতে বাধ্য করা, যৌন কর্ম করতে প্রলুদ্ধ করাকে বুঝায়। সাধারণত যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি (পুরুষ অথবা মহিলা) কোনো শিশুর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হয় সেটাই যৌন নির্যাতন হিসেবে গণ্য। শিশু যৌন নির্যাতন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি, কিশোর বা বয়স্ক শিশুর দ্বারা সংঘটিত হতে পারে।

 

যেভাবে শিশুরা যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হয়ঃ

১। আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে শিশুর বড় কাজিনরা বেড়াতে আসলে দূরে ঘুরতে নিয়ে যায়। তখন আদর করার নাম করে শরীরের বিশেষ যায়গায় হাত দেয়। আইসক্রিম, চকলেট কিনা দেয়ার কথা বলে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে  আদর করে, ঠোঁটে কপালে চুমো খায়।


২। দাদা সম্পর্কের এরকম কেউ কেউ ‘বউ বউ’ বলে ডাকে এবং কাছে নিয়ে আদর করে। এভাবে 'বউ বউ' বলে মেয়ে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর্বল করে দেয়, তারপর শিশুদের বিশেষ যায়গায় হাত দেয়, ক্ষেত্র বিশেষ জোর করে যৌন কর্ম করে।


৩। বাবা মায়ের বন্ধু বান্ধবরা অনেক সময় শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে। মাথা, পিঠে হাত বুলায়, এরই ফাঁকে স্পর্শ কাতর অঙ্গতে হাত চালিয়ে দেয়। মধ্য বয়স্ক এই সমস্ত আংকেল দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।


৪। বিশেষ কোন অনুষ্ঠান যেমন; বিয়ে বাড়ি, গায়ে হলুদ, জন্মদিন, সুন্নতে খাতনায় শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। এ সময় অনেক অভিভাবক অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় শিশুরা একা ও অরক্ষিত হয়ে পরে।


৫। আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসলে অনেক সময় অভিভাবক পাঁচ ছয় বছরের শিশুদেরকে তাদের সাথে ঘুমাতে দেন। বাসায় স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে অনেক সময় এমনটা হয়ে থাকে। এই ঘুমানের সময় শিশুরা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে আত্মীয় নামের এই কুলাঙ্গারা শিশুদেরকে যৌন  নিপীড়ন বা নির্যাতন করে।


৬। পরিচিত কেউ কার্টুন দেখার নাম করে শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দেয়। এক ফাঁকে মোবাইলে পর্নগ্রাফি চালু করে তার সামনে প্রদর্শণ করে। এতে শিশুরা সেদিকে আকৃষ্ট হয়। এই ফাঁকে সে শিশুকে যৌন নিপড়ন করতে পারে।


৭। অনেক সময় আত্মীয় স্বজন শিশুদেরকে তাদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সাথে নিতে চায়। সে সময় শিশুরা অতি উৎসাহে বাবা মায়ের কাছে বেড়াতে যাওয়ার বায়না ধরে। ফলে অভিভাবকরা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তাদের সাথে বেড়াতে দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে শিশুরা একা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকেন। ফলে নতুন কোন স্থান ও পরিবেশে ওঁৎ পেতে থাকা কামুক কোন আত্মীয় শিশুর যৌন নির্যাতন করে থাকে। 

৮। ভিড়ের মধ্যে চলাচল করার সময় অনেক দুষ্কৃতকারী শিশুদের স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দেয়। ফলে শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

৯। পরিবহন সেক্টর যেমন লঞ্চ, ট্রেন এবং বাসে  চলাচল করার সময় শিশুরা যৌন নিপীড়নের স্বীকার হতে পারে। 


১০। মেলা, উড়স শরীফ, স্কুলের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয়।

 

কোন পরিবারের শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশিঃ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত যে কোন পরিবারের শিশুরাই যৌন নিপড়ন বা নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তবে বস্তিবাসী, গরীব ঘরের শিশুরা তুলনামূলক বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এই যৌন নির্যাতন/নিপড়ন যারা করেন তারা অধিকাংশ প্রভাবশালী। পিতৃ-মাতৃত্বহীন এতিম শিশুদেরকে কওমী মাদ্রাসায় তাদের ওস্তাদ কর্তৃক যৌন নির্যাতন তথা বলৎকারের খবর পাওয়া যাচ্ছে । কথিত এতিমখানা বা আবাসিক মাদ্রাসায় শিশুদের দিনের পর দিন বলৎকার করা হচ্ছে। তার সামান্যই খবরে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া  ঢাকা শহর সহ সমস্ত শহর এলাকায় মেয়ে শিশুদেরকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখা হয়। এই সমস্ত শিশু গৃহকর্মীরা তাদের মালিকদের হাতে লালসার শিকার হন বা তারা তাদের হাতে যৌন নির্যাতিত হন। 


অনেক শিশু আবার বাড়ির গৃহকত্রী দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। গ্রাম থেকে উঠে আসা অনেক স্বামী পরিত্যাক্ত মহিলা তাদের শিশু সন্তানকে পাশের বাসায় রেখে কাজ করতে যান। এর ফাকে ঔ বাসার কোন পুরুষ হয়ত শিশুটিকে যৌন নিপড়ন করে থাকে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা তাদের পরিবারের নিকট আত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন বেশি, তবে তা নিম্নবিত্ত পরিবারের তুলনায় কম।

 

শিশু যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হলে কি কি আচরণ পরিলক্ষিত হয়ঃ বাবা মায়ের কাছে যৌনাঙ্গ ব্যাথার কথা প্রকাশ করে।নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দেখলে ভয়ে কেঁদে উঠে, তখন তার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। উক্ত ব্যক্তির কাছে যেতে ভয় পায়। পরিবারের কেউ উক্ত ব্যক্তির সাথে কথা বললে বা মেলামেশা করলে শিশু অস্বস্তিতে থাকে। দিনের যেকোন সময় বা রাতে ভয়ে চমকে উঠে, বিরবির করে কথা বলে। অন্ধকারে অতিরিক্ত ভয় পাবে। একলা ঘরে থাকতে মন চায়না। যৌন নির্যাতনের শিকার হলে শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত থাকে, তাদের মেজাজ খিটখিট করে, নতুন কিছু শিখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ডাক দিলে সাড়া দেয় কম। হাত-পা গুটিয়ে রাখে, কথা কম বলবে, অন্য শিশুদের সাথে খেলাধূলা কমিয়ে দিবে। বয়সে একটু বেশি বয়সের শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে নিজের যৌনাঙ্গে বারবার হাত দিবে, আবার সুযোগ পেলে অন্য বাচ্চাদের যৌনাঙ্গে হাত দিতে চাইবে। পুতুল বা খেলনার সঙ্গে যৌনতামূলক আচরন করবে। ব্যক্তিগত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে আগ্রহ বেশি দেখাবে। পরিবার বা কাছের ব্যক্তিদের সাথে জননাঙ্গ ঘষাঘষি করবে। যৌন ক্রিয়াকর্মের ছবি আঁকবে, ভিডিও দেখার চেষ্টা করবে। এসময় যৌন নির্যাতন বা নিপড়ীত শিশুদের জননাঙ্গে খামছি বা আঁচড় এবং রক্তপাত, ঠোটে জড়তা,; স্তন, পশ্চাদ্দেশ, তলপেট ও রানে আঁচড় বা কালশিটে দাগ দেখা যায়। তুলনামূলক বেশি বয়সের শিশুরা যৌন নিপড়নের শিকার হলে একমুখী আচরন, আত্মহত্যা প্রবণতা, মাদকের প্রতি আগ্রহ, জীবন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করা, স্কুলে যেতে অনীহা, লেখা পড়ায় মন না বসা, পর্ন দেখার প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়, এমনকি  শ্রুতিকটু কথা বলবে। 


কিভাবে শিশুকে যৌন নির্যাতনের হাত থেকে ক্ষা করা যায়ঃ সব সময় শিশুদের খেয়াল রাখতে হবে বর্তমানে সে কার সাথে আছে। আত্মীয় স্বজন, কাজিনরা বেড়াতে আসলে তাদের সাথে একা ছেড়ে না দেওয়া। কৌশলে তাদের থেকে শিশুদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করা। তারা যদি শিশুকে আদর করার জন্য কাছে টেনে নেয় তাহলে শিশুর কাছাকাছি থাকা এবং তাদের প্রতি খেয়াল রাখা। আইসক্রিম, চকলেট, বিস্কুট, খেলনা কিনা দেয়ার কথা বলে  শিশুদেরকে যাতে একা বাড়ি থেকে বের করে নিতে না পারে সেদিক খেয়াল রাখা। আদরের নামে যেন গলায় জড়িয়ে ধরা, ঠোঁটে, গালে চুমো খেতে না সেদিক নজর দেয়া। দাদা সম্পর্কের কেউ যদি মেয়ে শিশুদের ‘বউ বউ’ বলে ডাকে তাহলে তাকে সাবধান করা এবং তার সাথে শিশুকে মিশতে না দেয়া। বাবা-মায়ের বন্ধু বান্ধবদের নিকট শিশুকে একা না রাখা। বিয়ে বাড়ি, গায়ে হলুদ, জন্মদিন, সুন্নতে খাতনা এবং গেট-টুগেদার অনুষ্ঠানে শিশুদের প্রতি খেয়াল রাখা। আত্মীয় স্বজনদের সাথে শিশুদের একা বেড়াতে না দেয়া। পরিচিত কেউ শিশুর হাতে মোবাইল দিতে চাইলে তাকে নিষেধ করা। শিশুকে ভালো এবং মন্দের সাথে পরিচয় করানো। অন্যজন তার গায়ে কোথায় হাত দিতে পারবে আর কোথায় পারবেনা তার সম্পর্কে অবগত করানো। দুই বছরের অধিক মেয়ে শিশুদের বেলায় ঠোঁট, বক্ষদেশ, যৌনাঙ্গ এবং পশ্চাতদেশকে একান্ত ব্যক্তিগত স্থান হিসেবে পরিচিত করানো। ছেলে শিশুদেরকে যৌনাঙ্গ, ঠোঁট, এবং পশ্চাতদেশ অঞ্চলকে নিজেদের জন্য ব্যক্তিগত দেহ হিসেবে ধারণা দেয়া। অন্য কেউ যাতে এসব যায়গা স্পর্শ করতে না পারে সে সম্পর্কে সচেতন করা। এলক্ষ্যে তাদেরকে ছবি একে, এ্যানিমেশন ভিডিও এবং গল্পের মাধ্যমে ধারণা ও সচেতন করা। বাবা মা ছাড়া কেউ তার শরীরের এসব স্থানে হাত দিতে পারবে না এটা তাকে বলা। যদি কেউ গোপনে বা কৌশলে শরীরের এই অঙ্গগুলো কেউ স্পর্শ করে তাহলে তাৎক্ষনিক চিৎকার করতে পরামর্শ দেওয়া, অথবা সঙ্গে সঙ্গে বাবা মা বা অন্যকেউ যদি সামনে থাকে তাকে বলা। লোকের জমায়েত, লঞ্চ, ট্রেন, বাসের ভিড় সম্ভব হলে এড়িয়ে চলা। শিশুদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা, তাদেরকে নতুন নতুন জিনিসের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। ভুল করলে বকাঝকা না করা। তাদের ভালো মন্দ ধৈয্য সহকারে শোনা। অনাকাঙ্খিত নির্যাতনের ঘটনা যদি ঘটে থাকে তাহলে বাচ্চাকে দায়ি না করে তাদেরকে মানসিক সাহস যোগানো। যাতে সে এই অন্ধকার স্মৃতি ভুলে সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। শিশুদেরকে ধর্মীয় অনুশীলন এবং অনুশাসন সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান দান করা।

***

এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন