নাম নিয়ে বাহদুরীর কিছু নেই। একটি সুন্দর নাম থাকলেই যে আপনি সুন্দর মনের মানুষ হবেন এমন কোন কথা নেই।
What’s in a name? That
which we call a rose, by any other name would smell as sweet, (Shakespeare-
Romeo and Juliet, Act II, Scene II)
অর্থাৎ নামে কি আসে যায়? যেটাকে আমরা গোলাপ বলি, অন্য যে কোন নামে ওটা একই রকম সু-ঘ্রাণ ছড়াবে।
নাম দিয়ে হয়ত উপরে পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু ভিতরকার পরিচয় পেতে হলে আপনাকে সবকিছু তলিয়ে দেখতে হবে। আপনি যা খুঁজছেন, যা চাচ্ছেন তার ভিতরকার গুণ, কর্ম, সার্মথ্য হলো প্রধান। একই নামের কারণে মানুষ যেমন একই সম্মান পায়না, আবার একই নাম থাকার কারণে মানুষ স্থান বা বস্তুর মর্যাদা সমান দেয়না। সেইজন্য কথায় আছে; কোথায় চকিরতলা আর কোথায় আগারতলা। বাংলায় একটিত বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্য হলো, উড়তে পারলেই পাখি হওয়া যায়না, যেমন হয়না তেলাপোকা। অথাবা তেলাপোকাও পাখি, নুরুও একজন নেতা। কারো নাম মহাসেন থাকা মানে সে কিন্তু মস্তবড় বীর নয়। হতে পারে সে শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি।
মানুষের কর্মের মধ্যে তার নামের অন্তনিহিত পরিচয় লুকিয়ে থাকে। গাদ্দাফি নাম অনেক থাকতে পারে কিন্তু আসল গাদ্দাফি বলতে লিবিয়ার লৌহ মানব কর্নেল মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে বুঝায়। বাংলাদেশে হাজার হাজার সাদ্দাম আছে, কিন্তু বাপের বেটা সাদ্দাম বলতে ইরাকের সাবেক প্রসিডেন্ড সাদ্দাম হোসেনকে নির্দেশ করে। মুজিব, শেখ মুজিব সোনার বাংলায় অভাব নেই, কিন্তু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্দেশ করে। সেই জন্য আল্লামা রুমি তার নসনভি শরিফে বলেন;
তা’ সেফা’তাত্ রাহ্ নোমা’ ইয়াদ্ সূইয়ে যা’ত”
নাম অতিক্রম করে যাও এবং আল্লাহর গুণাবলির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ কর, যাতে তাঁর গুণাবলি তোমাকে পরম সত্তার দিকে পথ দেখিয়ে দেয়।
মানুষের মতপার্থক্য ভিন্ন ভিন্ন নাম হতে উৎপন্ন হয়। যখন সে নিগুঢ় অর্থে পৌছে,তখন সে শান্তি লাভ করে। (মসনভি, ২য় খন্ড, অধ্যায়-১১১)
প্রত্যেক মানুষ তার নামের পাশে কর্ম রেখে যান। সে যতই ক্ষুদ্র হউক আর সে যতই বড় হউক। ক্ষুদ্র ব্যক্তি হয়ত সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে তার নামের সার্থকতা রেখে যেতে পারেন না কিন্তু ছোট পরিসরে অর্থাৎ পারিবারিকভাবে সে অনেক অবদান রেখে যান। একই বস্তু ভিন্ন ভিন্ন ভাষাতে ভিন্ন ভিন্ন নামে উচ্চারিত হয়, কিন্তু বস্তুটি একই থাকে। নামে ভিন্নতা কিন্তু উদ্দেশ্য ও নির্দেশনা যে এক তা আল্লামা রুমি সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন- “চারজন বন্ধু ছিলো, তাদের মধ্যে একজন ইরানি, একজন তুর্কি, একজন আরব, একজন ইটালিয়ান। একদিন তারা এক শহরে একত্রিত হলো। সেই শহরের একজন সুহুদ তাদেরকে একটি টাকা উপহার দিলেন। উপহার পেয়ে ইরানি লোকটি বলল, আমি আঙ্গুর কিনে খাব, তুর্কি বলল, আমি উজম কিনে খাব, আরব বলল, আমি আনাব কিনতে চাই, ইটালিয়ান লোকটি বলল, আমি ইস্টাফিল কিনে খেতে চাই। তাদের দুর্ভাগ্য ছিলো, কেননা তারা একে অপরের ভাষায় অঙ্গুর এর পারিভাষিক শব্দ জানত না। তারা ভাবল, প্রত্যেকে আলাদা আলাদা জিনিষ কিনে খেতে চায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হলো। অবশেষে এক লোক আসলো যিনি এই চারটি ভাষা জানত, তিনি বললেন; যেই আঙ্গর, সেই ইস্টাফিল, অথবা যেই উজম সেই আনাব। সুতরাং তোমরা অনর্থক ঝগড়ায় লিপ্ত আছেন। অতঃপর তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সবাই আঙ্গুর কিনে খেল।
সৃষ্টিকর্তাকে মানুষ বিভিন্ন নামে ডাকেন। এই নামের ভিন্নতা কারণ হলো- ভাষাগত এবং ধর্মগত পার্থক্য। মুসলমান যেখানে এলহু, ইলাহা বা আল্লাহ্ বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করে সেখানে খ্রিস্টান গডস বলে পরিতৃপ্ত হন। হিন্দুরা কৃষ্ণ বা ভগমান বলতে বলতে অজ্ঞান। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মে সৃর্ষ্টিকর্তার যে বৈশিষ্ট্য দেয়া আছে তাতে কিছুটা ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সবাই তাকে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করে।
বর্তমান সময়ে পণ্যের ব্রান্ড অর্থাৎ নামে ট্রেন্ড চলছে, কে কত ভালো ব্রান্ডের পণ্য খাচ্ছেন বা পরিধাণ করছেন তার উপর মানুষ নজর দিচ্ছে।জীবন ধারণের উপর মানুষের সামাজিক প্রভাব নির্ধারণ হচ্ছে। এখানে অর্থই মান-মর্যাদা নির্ণয়ক, দন্ড, জ্ঞান গরিমান নয়। পন্যের ব্রান্ডের প্রতি মানুষের ঝোঁকের কারণে অনেক নামীদামী পণ্য এখন চীন দেশে নকল হচ্ছে। প্রসাধনী সামগ্রী নকল করার জন্য মাশাল্লা আমাদের চক বাজার তো বিশ্ব বিখ্যাত। 'পণ্যের ব্রান্ডের উপর সামাজিক প্রভাব নির্ধারণ' এই টেন্ডসি থেকে মানুষ বের হতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সামাজিক অবক্ষয় তলানীতে ঠেকবে। তাই তো পারস্যের কবি রুমি বলেছেন;
সুরাতে যা’হের চে জূযী এই জাওয়া’ন্
রো মাঅ’নী রা’ তালাব্ এই পাহলোয়া’ন
অর্থাৎ হে যুবক, উপর দিয়ে ফিটফাট কেন চাও। যদি হেডম থাকে ভিতরে হাত দাও।
বাংলাদেশে নামে মিল থাকার কারণে অনেক নিরাপদ মানুষ বছরের পর বছর জেল খাটার নজির আছে। সুতরাং নামে কি আসে যায়, কর্ম হউক পরিচয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন