পৃথিবীর উপর চন্দ্র ও সূর্যের মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই ভূ-পৃষ্ঠের পানি স্ফীত বা ফুলে যাওয়াকে জোয়ার
এবং সংকুচিত বা নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে। জোয়ার- ভাটা আমাদের দেশে একটি অতি সাধারণ বিষয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে সবাই কম বেশি জোয়ার ভাটার সাথে পরিচিত। নিম্নে জোয়ার ভাটার কারণ, প্রকারভেদ এবং গুরুত্ব আলোচনা করা হলোঃ
চিত্রঃ জোয়ার ভাটার মডেল
জোয়ার ভাটার কারণঃ উপরের সংজ্ঞা থেকে এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে জোয়ার ভাটা মূলত দুটি কারণে হয়ে থাক;
এক. পৃথবীর উপর চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ।
দুই. পৃথিবীর আহ্নিক গতি এবং পৃথিবী চারদিকে চন্দ্রের আবর্তন।
ব্যাখ্যাঃ চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করার সময় যে পাশে অবস্থান করে সে পাশে সমুদ্রের পানি, মাটি অপেক্ষা বেশি টান অনুভব করে। ফলে চাঁদের দিকে মুখ করে থাকা বিশাল জলরাশি ফুলে উঠে। অপরদিকে চাঁদের বিপরীত দিকে অবস্থান করা পানি মহাকর্ষ শক্তি দ্বারা কম আকৃষ্ট হয়ে ফুলে উঠার শক্তি হারায়, এতে করে ভাটার সৃষ্টি হয়। চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে, আবার পৃথিবীও তার নিজে অক্ষে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে। এই ঘুরতে বা আবর্তণ করতে পৃথিবীর একদিন সময় লাগে। আবর্তণকালীন সময়ে পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের দিকে থাকে সেখানে জোয়ার, এবং যে অংশ চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে সেখানে ভাটা হয়। ফলে চব্বিশ ঘন্টায় পৃথিবীর একই স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়।
জোয়ার ভাটার প্রকারভেদঃ নিম্নে জোয়ার ভাটার ৪টি ধরণ বা প্রকারভেদ ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলোঃ
১। মুখ্য জোয়ারঃ আমরা জানি চাঁদ
পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। প্রতিটি উপগ্রহ তার মাতৃগ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরে। চাঁদ যখন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে তখন পৃথিবীর কাছাকাছি অংশে মধ্যাকর্ষণ শক্তির
প্রভাব বেশি থাকে। চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির আধিক্যের কারণে সমুদ্রের জলরাশি স্ফীত হয়ে যে জোয়ারের সৃষ্টি করে তাকে মুখ্য জোয়ার বলে।
২। গৌণ জোয়ারঃ চাঁদ যখন পৃথিবী চারপাশে
আবর্তণ করে তখন সে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে দূরে সরে যায়। পৃথিবীর যে প্রান্ত চাঁদ থেকে দূরে অবস্থান করে সে প্রান্তে চাদের আকর্ষণ কমে যায়। এই কমে যাওয়া কারণে পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদের মিলিত মধ্যাকর্ষন শক্তি একটি নতুন সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রাতিগ শক্তি উৎপন্ন করে। কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে চারদিকের পানি শক্তির কেন্দ্র এসে জড়ো হয়ে একটি নতুন জোয়ারের সৃষ্টি করে। এখানে সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রাতিগ
শক্তির প্রভাবে যে জোয়ার সৃষ্টি হয় তাকে গৌণ জোয়ার বলে।
৩। ভরা কাটাল (Spring tide)ঃ যখন চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী একই লাইনে অবস্থান করে তখন জোয়ার সৃষ্টিকারী প্রভাব সর্বোচ্চ থাকে। এই সময়ের জোয়ারকে বলা হয় ভরা কাটাল বা তেজ কাটাল (Spring tide)। আমাদের দেশে ভরা কাটাল সাধারণত পূণিমা বা অমাবস্যায় সংগটিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, পুর্ণিমায় সূর্য, চন্দ্র এবং পৃথিবী একই সরল রেখায় অবস্থান করে এবং পৃথিবী চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে।
৪। মরা কাটাল (Neap tide): পৃথিবীর সাথে চন্দ্র ও সূর্য যখন আড়াআড়িভাবে অবস্থান করে তখন জোয়ার সৃষ্টিকারী শক্তির প্রভাব সর্ব নিম্ন থাকে। এই সময়ের জোয়ারকে বলা হয় মরা কাটাল (Neap tide)। মরা কাটাল সাধারণত শুল্কা অষ্টমী বা কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে হয়ে থাকে।
চিত্রঃ জোয়ার
জোয়ার-ভাটার উপকারিতাঃ জোয়ার ভাটার উপকারিতা অনেক। জোয়ার ভাটার কারণে সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেম সহজ হয়েছে। জোয়ার ভাটার আছে বলেই পানির মধ্যে চলনশীলতা বিদ্যমান। চলনশীলতা গতিকে কাজে লাগিয়ে পানি নিম্নঅঞ্চলকে প্লাবিত করে, ফলে পরিবেশের ইকো সিস্টেম রক্ষায় চেইন ভারসাম্য অবস্থায় থাকে। জোয়ার ভাটা জলজ প্রাণীদের পরিবর্তিত পরিস্থির (অভিযোজন) সাথে সহজে খাপ খাইতে পারে। বর্ষাকালে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে সমতলকে প্লাবিত করে। প্লাবিত জলরাশি নদীর দুকূলকে ছাপিয়ে পলি মাটির বিস্তৃতি ঘটায়। ফলে ফসলি জমির উর্বরতা বাড়ে। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জল বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সামুদ্রিক বর্জ ব্যবস্থাপনায় জোয়ার ভাটার প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগানো হয়। সমুদ্রের তলদেশে যে বর্জ্য থাকে ভাটার সময় তা জেগে উঠে। ফলে খুব সহজে মানুষ সেগুলোকে কুড়িয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে। জোয়ারের ফলে নদী আবর্জণা মুক্ত হয়। শীত প্রধান দেশে তাপমাত্রা নিচে নেমে গেলেও নদীতে স্রোত থাকার পানি জমাটবদ্ধ হতে বাঁধা দেয়। ফলে সে সমস্ত দেশের নদী বন্দরগুলো সচল থাকে। আবার যখন তাপমাত্রা হাল্কা বাড়ে তখন পানির চলন শক্তির প্রভাবে বরফ গলে যায়, এতে করে নৌ চলাচল স্বাভাবিক থাকে। তবে জোয়ার ভাটার কিছু ক্ষতির দিকও আছে। বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের সময় পানি চারদিকে প্লাবিত হয় আবার নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাটার টানে তা দ্রুত নিচে নেমে আসে। এতে করে নদী ভাঙ্গণ দেখা দেয়।
এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।
x
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন