আমিনুল ও রাইসুল সাহেব একই অফিসে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে যোগদান করেন।
আমিনুল সাহেবের বছর বছর প্রমোশন পেয়ে ডেপুটি ম্যানেজার হয়েছেন এবং তার বেতন বৃদ্ধি হয়েছে মাশাল্লাহ । অপর দিকে রাইসুল সাহেবের বেতন বেড়েছে খুব সামান্য এবং তিনি প্রমোশন পেয়েছেন একবার, তাও এক্সিকিউটিভ থেকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। তাছাড়া আমিনুল সাহেবকে বস অনেক ভালো জানেন। যেকোনো কাজের ব্যাপারে তিনি আমিনুল সাহেবের প্রতি আস্থা রাখেন। অপর দিকে রাইসুল সাহেবকে দিয়ে বস রুটিন মাফিক কাজ করিয়ে নেন। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমিনুল ও রাইসুল সাহেবের মধ্যে পেশাগত উন্নতির এই পার্থক্য কেন হয়েছে? উত্তর অবশ্যই পাবেন। তবে উত্তর পাওয়া আগে পেশাগত উন্নতির ক্ষেত্রে বসের আস্থা অর্জন করা কেন জরুরী এবং কিভাবে বসকে খুশি করা যায় তা জেনে নেওয়া যাক ডেস্ক পরিপাটি ও পরিস্কার রাখুনঃ দিনের একটি বেশিরভাগ সময় আপনি কর্ম এলাকায় (Work Station) ব্যয় করেন। সেই হিসেবে সেটি আপনার দ্বিতীয় বাড়ি (Second Home) বলা যেতে পারে। তাছাড়া পরিস্কার পরিছন্নতা আপনার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। ডেস্কের ফাইলের নাম, নাম্বারিং এবং ফাইল গুছিয়ে রাখুন। আপনার বস কখনো যদি আপনার ডেস্কে আসে তাহলে সে ধারণা নিতে পারবে 'আপনি নিট এন্ড ক্লিন ভাবে কাজ করেন।
বসকে বুঝার চেষ্টা করুনঃ অফিসের বসের সাথে কাজ করতে গেলে তাকে বুঝার চেষ্টা করুণ। সে আপনার থেকে কি চায় এবং আপনাকে নিয়ে তার প্রত্যাশা কি। বসের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করুণ। সে কোন ধরণের কাজ পছন্দ করে এবং কিভাবে কাজের আপডেট চায়। যদি সম্ভব হয় বসের গ্রামের বাড়ি এবং একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড জানার চেষ্টা করুন। সময় বুঝে কিছুটা কৌশলী হয়ে বসের প্রশংসা করুন। অহেতুক তেল মারতে যাবেন না, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বস ইজ রাইটঃ বসের সাথে কাজ নিয়ে তর্ক করতে যাবেন না। বস যেভাবে চায় সেভাবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করুণ। বসের সাথে কোন বিষয় নিয়ে আপনার দ্বি-মত হতেই পারে, আপনি কেন বসের সাথে একমত নন সেটা বসকে কৌশলে এবং ধীরে সুস্থে বলুন। বসকে কাজের আসন্ন প্রভাব এবং ফলাফল সম্পর্কে ভদ্রতাভাবে জানান। বস ভালো মনে করলে তার পরিকল্পনা (plan) পরিবর্তন করতে পারেন।
ব্যক্তিত্ব বজায় রাখুনঃ বসের সাথে কাজ কর্মে ব্যক্তিত্ব (Personality) বজায় রাখুন। এমন কোন কথা বা কাজ করবেন না যাতে বস আপনার সম্পর্কে নৈতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
রুচিশীল এবং চটপটে হোনঃ প্রজেক্টের ইনস্ট্রুমেন্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রুচিশীল হউন। বস যদি একাধিক জিনিস থেকে কোন একটা জিনিস পছন্দ করতে বলেন তাহলে ভালো মানের জিনিসটা পছন্দ করে রুচিশীলতার পরিচয় দিন। কাজের ক্ষেত্রে চটপটে হউন। ঢিলেমি আলসেমি মনোভাব নিয়ে কোন কাজ করবেন না। সময় মত কাজ শেষ করুন।
কাজ শেষ করুণ নির্দিষ্ট সময়ের (Time Line) মধ্যে: যেকোনো প্রজেক্ট বা কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করুন। কাজের মান (Work Quality) এর ক্ষেত্রে কোন আপোষ করবেন না। কোন কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে বসকে আগে থেকেই রিপোর্ট করুণ। জনশক্তি (Man Power) এবং আর্থিক বরাদ্ধ বাড়ানোর দরকার হলে বসকে জানান। নতুন কোন সমস্যা ফেস করছেন কিনা তাও জানান। নির্দেশনা বুঝতে সমস্যা হলে তার থেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করুণ।
টিম ওয়ার্কে অটো চয়েজ থাকুনঃ দলগত কাজের ক্ষেত্রে সবার সেরা হওয়ার (তারকা পারফর্মার) চেষ্টা করুন। সব সময় চেষ্টা করবেন টিমের মধ্যে এগিয়ে থাকতে। দলগত কাজের ক্ষেত্রে আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখুন। টিমের সব সদস্য যদি কোন কাজ করতে গড়িমসি করে তাহলে আপনি এগিয়ে আসুন। আপনি বসকে বুঝান যে আপনি এই কাজের যোগ্য এবং আপনার দ্বারা এই প্রজেক্ট সম্পূর্ণ করা সম্ভব।
অফিসের সময়সূচি বজায় রাখুনঃ অফিসে প্রবেস এবং প্রস্থানের (In & Out) সময় বজায় রাখুন। টাইম টেবিল মেনটেইন এর ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তী (Punctual) হউন। কখনো বসের আগে অফিস থেকে বের হবেন না। কোন কারণে দরকার হলে বসকে বলে বের হবেন।
কাজে ফাঁকি দিবেন নাঃ কথায় আছে অন্যকে ঠকাতে গেলে নিজেই ঠকতে হয়। তাই কখনো কাজে ফাঁকি দিবেন না, অথবা কাজকে স্কিপ করে চলে যাবেন না। দায়িত্বে অবহেলা করে কোন কাজ বা প্রজেক্টকে গোঁজামিল আকারে উপস্থাপন করবেন না। এতে আপনার সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা জন্মা দিবে। বাৎসরিক কর্মী মূল্যায়ন ফর্মে আপনার স্কোর প্রত্যাশা অনুযায়ী উঠবেনা।
সব সময় হাসিখুশি মনোভাব নিয়ে কাজ করুনঃ কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সব সময় হাসিখুশি থাকুন। কাজের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও একাগ্রতা বজায় রাখুন। এতে আপনার কাজ অন্যদের থেকে ভালো হতে বাধ্য। আপনার কাজ যদি সবার থেকে ভালো হয় তাহলে বছর শেষে বস অবশ্যই আপনার পদোন্নতি (Promotion) ও বেতন বৃদ্ধির (Salary Increase) ক্ষেত্রে সবার আগে আপনার কথা ভাববেন।
প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের পরিচয় রাখুন: যেকোন প্রজেক্ট বা কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবেদন তৈরির সময় পেশাদারিত্বের পরিচয় রাখুন। মূল বিষয় (Key Point) তুলে ধরুন। প্রতিবেদন অহেতুক লম্বা করবেন না। প্রতিবেদনে প্রস্তাবনা, মূল বিষয়, বাজেট, আর্থিক সক্ষমতা, পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাব, সমস্যা, সমাধান ইত্যাদি উল্লেখ করুণ।
উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরদানে বুদ্ধিদীপ্ত হউনঃ বস যেকোনো বিষয় আপনাকে প্রশ্ন করতেই পারেন। বিশেষ করে প্রজেক্টের মাঝপথে অথবা সমাপ্ত হওয়ার পর। প্রজেক্ট বা কাজের ব্যয়, সত্যতা, মানদন্ড ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে প্রশ্নের উত্তরদানে ভেবেচিন্তে ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিন। বাড়িত কথা না বলাই ভালো এবং যা সত্য তাই বলুন। এতে করে ভবিষ্যৎ ঝামেলা থেকে বাঁচবেন।
কাজের নিয়মিত আপডেট দেওয়াঃ বস যদি আপনাকে কয়েক দিন বা তারচেয়ে বেশি দিনের কোন কাজ দেন তাহলে কাজের নিয়মিত আপডেট দিন। এতে করে কাজ সম্পর্কে বস আইডিয়া পাবেন, এবং তারজন্যে পরিকল্পণা করা সহজ হবে।
বসের কাছাকাছি থাকুন: ওয়ার্ক স্টেশনে বসের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখুন। পারলে তার কাছাকাছি ডেস্কে বসবেন। এতে করে কাজ সম্পর্কে তার মতামত ও ধারণা নিতে সহজ হবে।
ব্যক্তিগত সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকুনঃ একজন মানুষ শতভাগ পারফেক্ট নয়। বসেরও কিছু দোষ ত্রুটি থাকতে পারে। তারও পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন আছে। তাই বসের ব্যক্তিগত সমালোচনা এড়িয়ে চলুন।
সাহায্যের হাত বাড়ান: বসকেও মালিকপক্ষ কিংবা তার উপর মহল কর্মকর্তাকে রিপোর্ট করতে হয়। বসেরও টাইম লাইন বাঁধা থাকে। কোন প্রজেক্ট যদি সময় মত শেষ না হওয়া আশংকা থাকে তাহেল বাড়তি (Over Time) কাজ করে প্রজেক্ট শেষ করুণ। বসের প্রতি সাহায্যের মনোভাব বজায় রাখুন। মনে রাখবেন, বস কোন কারণে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ গ্রুপ ব্যর্থ হবে। একটি প্রজেক্ট সফল না হলে টিমের সকল সদস্যদের দায়ভার নিতে হয়।
বিনয়ী হউনঃ চাল-চলন, উঠা- বসা, কথা- বার্তায় বিনয়ী হউন। কেননা বিনয়ী মানুষকে বড় ও মহৎ করে তোলে। কথায় আছে সন্মান না দিলে সন্মান পাওয়া যায়না। তাই বসের প্রতি সন্মানের দৃষ্টিতে কথা বলুন। কখনো অসৎ আচারণ কিংবা বেয়াদবি করবেন। ছোট খাটো ভুল হলে তা স্বীকার করুণ।
নিজেকে নির্ভরযোগ্য কর্মী হিসেবে গড়ে তুলুনঃ আপনার উর্ধতন কর্মকর্তার নিকট দক্ষ, বিনয়ী ও নির্ভরযোগ্য কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলুন। বস যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে আপনার উপর যেন আস্থা রাখতে পারে এমনভাবে নিজেকে সেট করুন।
শুভদিনে শুভেচ্ছা জানানঃ বসের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ম্যাসেজ করুণ। সম্ভব হলে সামনা-সামনি (Face to Face) শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। জন্মদিনে ফুল কিংবা ফুলের তোড়া দিতে পারেন। কেক কাটার আয়োজন করলে আরো ভালো হয়। ঈদ কিংবা পূজার শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। দাওয়াত দিলে আরো ভালো হবে।
কাজের রেকর্ড হালনাগাদ করুণঃ কম্পিউটার এর ওয়ার্ক ফাইল এবং প্রিন্ট করা ডকুমেন্টস গুলোর তালিকা হালনাগাদ করুণ। সেকশন অনুযায়ী ফাইলের তালিকা ও সিরিয়াল দিতে হবে। বস যখন যে ফাইল চাইবেন সাথে সাথে সে ফাইল দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে।
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো অফিসে মেনে চললে একজন দক্ষ ও সফল কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবেন। দিন শেষে মানুষ সফলতা চায়। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে মানুষ বছর বছর পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির আশা করে। উপরে উল্লেখিত আমিনুল সাহেব এই নিয়মগুলো মেনে চলতেন, তাই তার উন্নতির গ্রাফ ছিলো ঈর্ষান্বিত। অপর দিকে রাইসুল সাহেব নিয়ম মানার ক্ষেত্রে ছিলেন মারজিনাল (Marginal) তাই তিনি ক্যারিয়ারকে সেভাবে উন্নতি করতে পারেননি। পরিশেষে আপনার কর্ম জীবন সুখের ও সমৃদ্ধি হউক এই কামনা করি।
লেখন, শাহাদাৎ হোসাইন,
সিনিয়র কার্যনির্বাহী, কর্পোরেট এ্যাফিয়ার্স,
এ. কে খান এন্ড কোম্পানি লিমিটেড।
ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগ্রহীত।
এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের সামন্য উপকারে আসে তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন