মিরপুর শত্রুমুক্ত করার অভিযান ও জহির রায়হান এর নিঁখোজ হওয়ার রহস্য-
১৯৭২ সাল: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের অব্যবহিত পরের সময় জুড়ে বাংলাদেশ নামের শিশু রাষ্ট্রটি নানামুখী সমস্যাসংকুল ছিল। এর মধ্যে
ঢাকা সংলগ্ন মিরপুর এলাকায় বিহারি, রাজাকার ও তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্যের সংগঠিত প্রতিরোধ সদ্য স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। পাকিস্তানিদের সরবরাহকৃত বিপুল
পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মিরপুরের বিহারিদের হাতে ছিল। বেশ কিছু
পাকিস্তানি সৈন্য, ইপিসিএএফ মুজাহিদ সদস্য বিহারিদের বাসাবাড়িতে লুকিয়ে তাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিল। এদের অনেকে
আবার স্বাধীনতাযুদ্ধের আগেই এসব বিহারি পরিবারের মেয়েদের পাণি গ্রহণ করেছিল। এই পাকিস্তানিদের
প্ররোচনা অথবা নিজেদের বুদ্ধিতেই মিরপুরের বিহারিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে
এই অবস্থা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না।।
১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আত্মসমর্পণের পর থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০ম বিহার রেজিমেন্ট মিরপুরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এই রেজিমেন্টের সদস্যরা ওই এলাকার বিহারি মুসলিম অধিবাসীদের মতো ভারতের একই অঞ্চল থেকে আসা এবং একই ভাষাভাষী হওয়ায় তাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হওয়ার কথা শোনা যায়নি। ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর (তাঁর ভাষায় বিদেশি সৈন্যদের) দেশে ফেরার জন্য তাগিদ দিতে থাকেন। ভারত সরকার সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য বঙ্গবন্ধুর ক্রমাগত চাপের সম্মুখীন হয়ে বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা ভারতীয় ইউনিটগুলোকে প্রত্যাহার করে নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইউনিট মোতায়েনে রাজি হয়।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মিরপুরের বিহারি এলাকাগুলোতে অস্ত্র উদ্ধার এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের গ্রেপ্তারের জন্য বাংলাদেশ পুলিশকে সহায়তার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি ১০ম বিহার রেজিমেন্টের পরিবর্তে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মোতায়েনের নির্দেশ দেন। সেই দিনই ওই ইউনিটের ডি কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের (পরে মে. জেনারেল) নেতৃত্বে মিরপুরে ১২ সেকশনে অবস্থান নেয়। এ সময় ১০ম বিহার রেজিমেন্টের অফিসাররা তাকে এই ধারণা দেয় যে মিরপুরে তেমন কোনো সমস্যা নেই।
পরদিন ৩০ জানুয়ারি সকালেই ২য় ইস্ট বেঙ্গলের নিও মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রমের উপস্থিতিতে কর্নেল সফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফ মিরপুর এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে মিরপুরের বিহারি এলাকাগুলোতে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারকাজ সফল করতে হয়, তবে শুধু ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টই যথেষ্ট নয়। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, ১ ও ২ সেকশনের দায়িত্ব ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলকে দেওয়া হবে। ২য় ই বেঙ্গলের দায়িত্ব দেওয়া হলো ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনের ওপর। এ ছাড়া ৯ম ইস্ট বেঙ্গলকে ৬, ৭ ও ৮ নম্বর সেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৯ জানুয়ারি রাতেই পুলিশের একটি দল ২য় ইস্ট বেঙ্গলের পূর্বোক্ত কোম্পানিটির সঙ্গে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যোগ দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (আমি ছিলাম ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক) ও ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কগণ ছিলেন যথাক্রমে মোর মইনুল হোসেন (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) ও মেজর আইনউদ্দিন (বীর প্রতীক, পরে মেজর জেনারেল)। আমাদের ওপর নিজ নিজ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মিরপুরের চলমান অরাজক অবস্থার অবসান ঘটিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মিরপুর ১ ও ২ নম্বর সেকশন এলাকা রেকি ও সৈন্য মোতায়েন: মিরপুরে মোতায়েনের আদেশ পেয়ে আমি জয়দেবপুরের ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রিয়ার বা পশ্চাৎ- দল ছাড়া সম্পূর্ণ ইউনিটকে দ্রুত তৈরি হয়ে মিরপুর যাওয়ার আদেশ দিই এবং নিজে একটি জিপে আমার অপারেটর, ড্রাইভার ও প্রহরীকে নিয়ে দ্রুত মিরপুরে রেকি (রেকোনাইসেন্স) করতে চলে আসি।
২য় ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে বিহারিদের সংঘর্ষ, ১১-১২ নম্বর সেকশন, মিরপুর : অপারেশনের প্রথম দিন সকালেই একটি চরম দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। সেদিন ৩০ জানুয়ারি সকালবেলা ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির সৈনা ও কিছু পুলিশ সদস্য হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে গিয়েছিল অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে। আগেই বলেছি, আমি তখন মিরপুর ১ ও ২ সেকশন এলাকায় আমার ব্যাটালিয়নকে মোতায়েনের উদ্দেশ্যে রেকি করছিলাম। কিছু সময় পরপর এক- দুইটা গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল ১২ নম্বর সেকশনের এদিক থেকে। ঘটনাটা কী, তা দেখার জন্য আমি ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনের দিকে রওনা হলাম। আমার বাহন ছিল একটি টয়োটা ছিল। সঙ্গে আমার ড্রাইভার নায়েক আবু তাহের ও দু’জন সশস্ত্র সৈনিক। আমি মেজর মইনের অবস্থানে পৌঁছে দেখি তিনি এবং তাঁর অফিসার ও জেসিওরা বিহারিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাশাপাশি দুটি পৃথক স্থানে জমা করছেন
যেসব বিহারিক কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া যাচ্ছিল, তাদের পাশেই এক জায়গায় উপুড় করে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কয়েকজন সশস্ত্র সৈক তাদের পাহারা নিচ্ছিল। মেজর মইন তখন এই অপারেশন নিয়ে খুবই বাস্ত ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে অপারেশন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি আমাকে সময় দিতে পারলেন না। অপারেশনটি যেভাবে চলছিল, তা আমার কাছে মোটেই ভালো লাগেনি। মনে হচ্ছিল, যেসব বিহারিকে উপুড় করে রাখা হয়েছে, তার মধ্যে যে কোট হঠাৎ করে পাশেই রাখা অস্ত্র ও গুলি নিয়ে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। কোনো অফিসরাকে না পেয়ে আমি এই ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজরকে ডেকে বিষয়টি তাঁর নজরে আনলাম এবং তাকে মেজর মইনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে বললাম ।
উল্লেখ্য, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারকে রাজাকার আলবদর সদস্যরা তাঁর বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার পর থেকে তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তি, টেলিফোনে জহির রায়হানকে জানিয়েছিল যে তাঁর ভাই শহীদুল্লা কায়সার বেঁচে আছেন এবং মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের কোনো এক স্থানে বিহারিরা তাঁকে আটকে রেখেছে। আলোচ্য অপারেশনের দিন সকালে জহির রায়হান সেনাবাহিনীর সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ভাইকে খোঁজার জন্য তাঁকে সঙ্গে নিতে। এ সময় আমি সেখানে ছিলাম। ব্রিগেডিয়ার খালেদ যেহেতু মিরপুর অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন, তাই তিনি হয় বেঙ্গলের সৈন্যদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমি অপারেশনের এলাকায় জহির রায়হানকে দেখতে পাই। তিনি তখন তাঁর ভাইকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন। বন্দী বিহারিদের কাছে ভাইয়ের ব্যাপারে তারা কিছু জানে কি না জিজ্ঞাসা করছিলেন।
যেহেতু অপারেশনটি পরিচালনার মান আমার মনঃপুত হচ্ছিল না, আর এ ব্যাপারে আমার কিছু করারও ছিল না, তাই আমি সেখানে আর অপেক্ষা না করে নিজের দায়িত্বাধীন এলাকার দিকে রওনা হলাম। আমি যখন ৬ নম্বর সেকশনের কাছাকাছি পৌঁছালাম, তখন অকস্মাৎ ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনের দিকে তুমুল গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। তখন আমি গাড়ির গতি একটু কমিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম গোলাগুলি ঠিক কোথায় হচ্ছে। সেই মুহূর্তে কাছের একটা বাড়ির জানালা দিয়ে করা এলএমজির একটা বার্স্ট ফায়ার আমার গাড়ির নানা স্থানে এসে লাগল । গুলিতে মুহূর্তেই আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কারও গায়ে গুলি লাগল না। আমার ড্রাইভার আবু তাহেরকে তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি ঘুরিয়ে নিরাপদ স্থানে তা নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলাম।যেতে যেতেই দেখলাম সামনের দিক থেকে একটা জিপ গাড়িতে করে কে যেন আসছে। কাছে এলে দেখতে পেলাম সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার সফিউল্লাহ, বীর উত্তম (পরে মেজর জেনারেল) গাড়িতে আছেন। আমি ইশারা করে তাঁর গাড়ি ঘোরাতে বললাম এবং সেকশন ১১ ও ১২-এর দিকে যেতে বারণ করলাম। তিনি আমার ইশারা শুনলেন এবং আমার গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে একটি নিরাপদ স্থানে এলেন। সেখানে আমি তাকে যা যা দেখেছি, তা বর্ণনা করলাম। ইতিমধ্যে ১১, ১২ ও ৬ নম্বর সেকশনের দিকে তুমুল গোলাগুলি চলছিল। ব্রিগেডিয়ার সফিউল্লাহ তাঁর গাড়ি নিয়ে সেনাসদরের দিকে ছুটলেন আর আমি আমার গাড়ি নিয়ে নিজের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ১ ও ২ নম্বর সেকশনে চলে এলাম।
ফেরার মাত্র ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চরম দুঃসংবাদটি পেলাম যে পশ্চাদপসরণরত ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে পেছনের প্লাটুনটি, যেটি কাভারিং ফায়ার প্রদান করছিল, সেই প্লাটুনের প্লাটুন কমান্ডার ২য় লেফটেন্যান্ট সেলিমসহ প্লাটুনের ৩৫ জন সৈনাকে বিহারিরা মেরে ফেলেছে। অন্য একটি প্লাটুন হাবিলদার বারকির নেতৃত্বে একটি খাল সাঁতরে ওপারে গিয়ে মিরপুর বিল এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। তাদেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরে জানা যায়, ওই দুটি প্লাটুনের মোট ৪২ জন সৈনিক নিহত হয়েছিলেন। মেজর মইনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর ঘটনাস্থলে থাকা জহির রায়হানকে আর কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া গেল না। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসেও ওই ব্যাটালিয়নের এত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, যা মিরপুরের ঘটনায় হয়েছিল।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের আগমন: মিরপুর পৌঁছে আমি সেখানে অবস্থিত বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির একটি ভবনে আমার সদর দপ্তর স্থাপন করলাম। প্রথম দিনেই আমি ১ ও ২ নম্বর সেকশন এলাকা নিজে রেকি করলাম এবং বিহারিদের অবস্থান কতটা শক্ত, সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। আমি আশ্চর্য হলাম যে প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই বিহারিরা স্বয়ংক্রিয়, আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, এলএমজি ও স্টেনগান নিয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমি ১ নম্বর সেকশনে মিরপুর মাজারে দুটি কোম্পানি এবং ২ নম্বর সেকশনে একটি পরিত্যক্ত পুকুরের চারপাশে দুটি কোম্পানিকে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম। আমার কোম্পানিগুলো অবস্থান গ্রহণ তদারক করার সময় আমি স্বচক্ষে কিছু কিছু নিদর্শন দেখলাম, যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালিদের ওপর বিহারিদের উদ্যোগে সংঘটিত গণহত্যার প্রমাণকে তুলে ধরে।
মাজারের পাশেই একটা মজা পুকুর ছিল। এই পুকুরের পাড়ে নানা জায়গায় মাটি খোঁড়া দেখতে পেলাম। এই আলগা মাটি সরালেই দু-একটা মানুষের লাশ। পাওয়া যেতে লাগল। এখানেই এক জায়গায় দেখলাম গৌড়া মাটির নিচ থেকে একটা মহিলার কাচের চুড়ি অলংকৃত হাত বেরিয়ে আছে! আমরা মাটিগুলো সরিয়ে ফেলার পর মহিলার মৃতদেহটি বেরিয়ে এল। শুধু ব্লাউজ পরা উলঙ্গ মৃতদেহ। তাকে জবাই করা হয়েছিল। সে এক বীভৎস দৃশ্য। আমরা যখন। হতভাগিনী মহিলার লাশ কবর থেকে ওঠাচ্ছিলাম, তখন কাছের টিলার ওপর দাড়িয়ে ছোট শিশু কোলে এক লোক ডুকরে কেঁদে বলল, 'স্যার, এইটা আমার স্ত্রীর লাশ। আমার কোলের শিশুটির মা সে। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সে আমাকে আরও জানান, শুধু তার স্ত্রীই নয়, এভাবে আরও বহু নারী ও পুরুষকে চরম অত্যাচার ও হত্যা করে সেই পুকুরের বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল বিহারি রাজাকাররা। আমাকে সে বলে চলেছিল, "স্যার। এরা এভাবে বহু সুখের সংসারকে শেষ করে দিয়েছে। এদেরকে ক্ষমা করবেন না।”
এরপর আমি আমার সৈনিকদের আরও লাশের সন্ধানে নিয়োজিত করলাম। মজা পুকুরটির প্রায় মাঝখানের তলদেশে মাটি খুঁড়ে একটি গণকবরে আমরা পাঁচ-ছয়টি নারী-পুরুষের লাশ উদ্ধার করলাম। তাদের প্রত্যেকের শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও আঘাতের চিহ্ন ছিল সুস্পষ্ট। কাছাকাছি আরও একটা কবরের মাটি খুঁড়ে আমরা কাফনের কাপড় পরানো এক মহিলার লাশ পেলাম। তারই সঙ্গে অপর একটা লাশসদৃশ কাফনের গিট খুলে আমরা ১৫-২০টি জি-৩ রাইফেল ও রাইফেলের গুলি লুকানো অবস্থায় উদ্ধার করলাম। স্বভাবতই আমার সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ও ক্ষোভ ফুঁসে উঠছিল। আমি নিজেও মনে মনে একদিকে নরপশুদের শাস্তি প্রদান করা আর অন্যদিকে ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব—এই দুটি শক্তিশালী তাড়নার সংঘাত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম।
আমি ২ নম্বর সেকশনে আমার সৈনাদের নিয়ে প্রবেশ করতে মনস্থির করলাম। হাবিলদার বাশারের শাহাদাতবরণ: সেদিনই, ১১ ও ১২ নম্বর সেকশন থেকে আমার এলাকায় পৌঁছার পর ৬ নম্বর ও ২ নম্বর সেকশনের মাঝামাঝি একটি বিল্ডিংয়ের নিচে সামনের বারান্দায় আমার কিছু সৈনিক বিশ্রাম নিচ্ছিল। এ সময় নম্বর সেকশনের দিক থেকে হঠাৎ বিহারিদের ছোড়া একটি গুলি বিশ্রামরত হাবিলদার বাশারের গলায় লাগলে সে শাহাদাতবরণ করে। অত্যন্ত সাহসী ও নির্ভীক এই সৈনিক মূলত বিডিআর থেকে আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগ দিয়েছিলে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাশার অনেক সাহসিকতাপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিল। তার এভাবে হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় আমি অনেক কষ্ট পেলাম। বাশারের দাফন সম্পন্ন করার জন্য আমি সুবেদার মেজবকে আদেশ দিলাম এবং ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের আরও সাবধান হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম, যেন পরবর্তী সময়ে কেউ এমন দুর্ঘটনার শিকার না হয়।
বিহারিদের সঙ্গে ১ম সংঘর্ষ, ২ নম্বর সেকশন মিরপুর: পরদিন (৩১ জানুয়ারি) সকালে ২ নম্বর সেকশনে প্রবেশের সময় আমরা শক্তি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলাম। রাস্তার পাশে একটা পাকা একতলা বাড়ি থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো এলএমজির স্বয়ংক্রিয় গুলি আসছিল। আমরা রাইফেল দিয়ে ওই বাড়ির জানালাতে বহুক্ষণ ধরে গোলাগুলি করেও প্রতিপক্ষের ওই গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে পারছিলাম না। তখন বাধ্য হয়ে আমি ৭৫ মিমি রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সাপোর্ট কোম্পানি থেকে একটি রিকয়েললেস রাইফেল এসে ফায়ার অবস্থান গ্রহণ করল। আমি মাইক লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে এই বলে ওয়ার্নিং দিলাম যে, তারা যদি গোলাগুলি বন্ধ করে আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে আমি তাদের ধ্বংস করে দিতে বাধ্য হব। এর প্রত্যুত্তরে ওই বাড়িতে অবস্থানরত বিহারিরা অশ্রাব্য ভাষায় আমাদের গালিগালাজ করতে লাগল ।
এরপর যে জানালা থেকে ফায়ার আসছিল, সেটি লক্ষ্য করে রিকয়েললেস রাইফেলের গোলা দাগার সঙ্গে সঙ্গে সব যেন চুপচাপ হয়ে গেল। গোলাগুলিও বন্ধ হয়ে গেল। আমি আমার একটি প্লাটুনকে ওই বাসায় তল্লাশি করতে পাঠালাম। তারা ফিরে এলে জানা গেল ঘরটিতে কয়েকজন আহত বিহারি ছাড়া আর কোনো সক্ষম শত্রু নেই। সেখানে বিহারিদের দুটি এলএমজি ছিল, যা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আমি আহত বিহারিদের আমার ব্যাটালিয়নের এমআই রুমে চিকিৎসা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছিলাম। এই ঘটনার পর ২ নম্বর সেকশনের দখল বিনা বাধায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের হাতে এল। এদিন বিহারিরা একটিবারের জন্যও আমার সৈন্যদের ওপর গুলি করার সাহস দেখায়নি। তবে আমার এক সৈনিক কোথা থেকে একটি কাপড়ের পুঁটলি আমার কাছে নিয়ে এল। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ওই পুঁটলিতে অনেকগুলো মানুষের চোখ একত্র করে রাখা হয়েছে। এগুলো ছিল গণহত্যার শিকার বাঙালিদের চোখ। আমি সন্দেহভাজন বিহারিদের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, কিন্তু তাদের কেউই কোনো স্বীকারোক্তি করল না। আমার সৈন্যদের উত্তেজনা আর প্রতিশোধ স্পৃহা তখন প্রায় ফেটে পড়ার জোগাড়। তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে রাখাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছিল। আমি অনেক বুঝিয়ে- সুঝিয়ে তাদের কিছুটা শান্ত করলাম। আমি আমার একজন নায়েব সুবেদারের নেতৃত্বে ৪০ জন সদস্যের একটা টিম গঠন করে তাদের ওপর সন্দেহভাজন বাঙালি হত্যাকারীদের শনাক্ত করার দায়িত্ব নিলাম আর বাকি সেনাদের সরাসরি বিহারিদের ওপর কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ দিলাম না।
এভাবে আমি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করলাম। যা-ই হোক, সাধারণ বিহারিদের মধ্য থেকে সন্দেহভাজন বিহারিদের (প্রতিরোধে সক্ষম সুস্বাস্থ্যের অধিকারী পুরুষ, এলাকার নয় এমন পুরুষ, সন্দেহভাজন সামরিক চালচলনধারী এমন) আলাদা করার কাজটি পরবর্তী দুই দিনের মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছিল। আমার বিশেষ টিম এদের স্থায়ীভাবে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে রেখে এল, যাতে তারা মিরপুরে আমাদের অপারেশনে কোনো বাধা দিতে না পারে। অন্যদিকে যেসব বিহারিকে নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করলাম, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া ক্যাম্পে পাঠানো হলো।
১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের অভিযান : ৩১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সেনাপ্রধানের আদেশে আদিষ্ট হয়ে আমি আমার একটি কোম্পানি সৈন্যসহ ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনের Cordon & Search (অবরোধ ও তল্লাশি) অপারেশন পরিচালনা করলাম। আমার সৈনিকেরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ১১ ও ১২ নম্বর সেকশন থেকে ৫০টির ওপরে রাইফেল, ৩টি এলএমজি এবং বিপুল পরিমাণ গুলি উদ্ধার করলাম। এসব অস্ত্র যেসব বিহারির কাছে পাওয়া গেল, তাদের আমি কঠোর সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। উল্লেখ্য, ৬ নম্বর সেকশনে আমার গাড়িতে যে বিহারি রাজাকার এলএমজি দিয়ে গুলি করেছিল, সেই অস্ত্রটি ও এর অপারেটরকে আমি খুঁজে বের করে তার সঙ্গে পরিচিত হতে সক্ষম হয়েছিলাম।
বিহারিরা ছাড়াও আমাদের হাতে এমন কিছু লোক ধরা পড়ল, যারা বিহারি ছিল না। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বোঝা গেল, এরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশ, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট ইত্যাদির দলছুট সৈনিক। এদের কেউ কেউ ছিল বিহারি মেয়েদের স্বামী, যাদের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। আর অন্যরা বিহারিদের সঙ্গে মিশে প্রতিরোধযুদ্ধ চালাতেই সেখানে অবস্থান করছিল। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিহারিদের প্রশিক্ষণ ও সামরিক নেতৃত্ব দেওয়া। আমি এদের বন্দী করে জেনেভা কনভেনশন ও পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ঢাকায় অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিই।
১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে অপারেশন চালানোর সময় আমার সৈনিকেরা যখন ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছিল, তখন আমি একটা বিষয় লক্ষ করলাম, বিহারিদের বাড়িগুলোর বিভিন্ন জানালা দিয়ে রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এমনভাবে কাভার করে এলএমজি ও অন্যান্য অস্ত্রের অবস্থান বসানো হয়েছিল, যা সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার মনে হয়, এই বিষয়টি ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ও অন্য অফিসারদের দৃষ্টি এভিয়ে গিয়েছিল। তাই যখন তাদের ওপর আক্রমণ এসেছিল, তখন তারা শত্রুর অবস্থানগুলো চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। ফলে বিহারিদের অ্যামবুশটি সফল হয় এবং ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে।
ওই ব্যাটালিয়নের একটি প্লাটুন মিরপুর বিলের ভেতরে সাঁতরে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার ফলে আরও অনেক সৈন্য হতাহত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। এই ঘটনার ফলে ২য় ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুর অভিযান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং আমার ব্যাটালিয়ন ও মেজর আইনউদ্দিনের ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর গোটা মিরপুর অভিযানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। এরপর আমরা মিরপুর অভিযানটি সফলভাবে সম্পন্ন করি। অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার ও বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে বন্দী করতে সক্ষম হই। মিরপুরে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
লেখার উৎস: স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন, লেখক- এইচ এম আব্দুল গাফ্ফারম বীর উত্তম।
চলবে--
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন